ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

অধরা ১৩৪ মানব পাচারকারী

প্রকাশনার সময়: ১০ অক্টোবর ২০২১, ০৫:৪৯

‘আমার হাত ও পা ভেঙে ফেলেছে, আমি মরে যাচ্ছি, তুমি টাকা দিলা না। তোমারে না কইছি দুলাভাইকে বলো, তাড়াতাড়ি ১০ লাখ টাকা দিতে। এরা মানুষ মেরে ফেলছে।’ ২০২০ সালের মে মাসের ১৩ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে বাঁচার আকুতি জানিয়ে মোট ১১টি ভয়েস রেকর্ড পাঠানো হয় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার ইছার উদ্দিনের স্ত্রী সুমির ফোনে। ওই রেকর্ডের সূত্র ধরে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন সুমির দুলাভাই মোহাম্মদ আলী। ওই মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দুইজনকে গ্রেফতার করে।

শুধু সুমিই না, মুক্তিপণ না পেয়ে ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়া পাড়ি জমানো ৩৭ বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ বাংলাদেশিকে সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদায় গুলি চালিয়ে হত্যার আগে অনেকের স্বজনরাই এ ধরনের বাঁচার আকুতি শুনেছিল। কিন্তু হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের কিছুই করার ছিল না। সৃষ্টিকর্তার ভরসায় বসে ছিলেন হতভাগা স্বজনরা। গুলির ওই ঘটনায় আহত হন আরো ১১ বাংলাদেশি।

ঘটনাটি বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারের পর নড়েচড়ে বসে সরকার। একযোগে দেশব্যাপী অভিযান চালানো হয় মানবপাচারকারীদের গ্রেফতারে। মামলা হয় ২৯টি। এর মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডতে) তদন্তভার যায় ২৫টি মামলার। এসব মামলার মধ্যে সম্প্রতি ২৪টির চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। সেখানে ২৯৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৭১ জনকে। ৬ জনের নামে ইন্টারপোলে রেড আ্যালার্ট জারি করা হলে ২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৩৪ জনকে ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, মানব পাচারের অভিযোগে দায়ের করা ২৪ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত বাকি ১৩৪ মানব পাচারকারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বাকি একটি মামলার তদন্তও শেষ পর্যায়ে। এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লিবিয়ায় মানব পাচার করছেন বলে তথ্য রয়েছে। তারা ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইউরোপে ঝুঁকিপূর্ণ মানব পাচার করছে। এসব ঘটনায় প্রতারিত হয়ে অনেকে টাকা ফেরত পাওয়ার পর মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে আগ্রহী হন না। আবার কিছু ব্যক্তি মামলা করলেও মানব পাচারকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা দেন না। এ কারণে তাদের ধরতে পুলিশের বেগ পেতে হয়।

জানা গেছে, দেশের ভেতরে মানব পাচারের ১৪ চক্র ও লিবিয়া-ইউরোপে আরো ৪ চক্র মিলে মোট ১৮ চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা বাংলাদেশিদের ইউরোপে নিয়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়ে পাচার করে আসছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শত শত বাংলাদেশিকে সংগ্রহ করে দালাল চক্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে আসছে চক্রের সদস্যরা। এই চক্রের সদস্যদের যোগসাজশে আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা ২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে সাহারা মরুভূমি অঞ্চলের মিজদায় গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ঢাকাসহ সারাদেশে মামলা হয়েছিল ২৯টি। এর মধ্যে ২৪টি মামলায় ২৯৯ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। বাকি ৪ মামলার মধ্যে ৩টি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও একটি মামলা জেলা পুলিশ তদন্ত করেছে।

সূত্রমতে, লিবিয়ায় মানব পাচারে চারটি দেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করেছেন মানব পাচারকারী চক্র। দেশে ১৪ চক্রের ৩ শতাধিক সদস্য সক্রিয় আছে। লিবিয়ায় সক্রিয় আছে বাংলাদেশি আরো চারটি চক্র। দালাল ধরে লিবিয়ায় যাওয়া এসব ভুক্তভোগীকে খরচ করতে হয়েছিল ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। ভারত, নেপাল, দুবাই ও মিসর ঘুরে লিবিয়া যাওয়ার পর চক্রের সদস্যদের হাতে জিম্মি করে রাখা হয় ভাগ্যের অন্বেষণে দেশছাড়া যুবকদের। এরপর আরো ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দাবি করা হয়। ওই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের নির্যাতন করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। টাকা কালেকশন করে দেশে অবস্থানরত পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। তারা ওইসব টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দুবাইতে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে ধাপে ধাপে ওই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয়।

এছাড়া, দুবাই, আম্মান ও লিবিয়া হয়ে ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে আলাদা একটি চক্র। এই চক্রের সদস্যরা ইউরোপকেন্দ্রিক মানব পাচার করে। তাদের কেউ লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার পর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে দুবাইয়ে অবস্থানরত আফ্রীন আহমেদ মূল হোতা। সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে ঢাকায় অবস্থান করেন সুজন, মামুন ও কাউসার। ঢাকার ফার্মগেটের মনিপুরীপাড়ার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এসব অপকর্ম চালানো হয়েছে। মানব পাচার সিন্ডিকেট সদস্যরা দুবাই, আম্মান ও লিবিয়া হয়ে ইতালিতে অবৈধভাবে লোক পাঠায়। বিদেশে লোক নেয়ার পর তাদের জিম্মি করে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের পর তাদের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ করে টাকা আদায় করা হয়। এসব টাকার ভাগ দেশে ও দেশের বাইরে অবস্থানরত মুক্তিপণ আদায়কারীদের কাছে পৌঁছে যায়।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা জানান, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা দুবাইয়ে যাওয়ার পর আফ্রীন আহমেদ তাদের রিসিভ করেন। এ সময় তাদের (অভিবাসনপ্রত্যাশী) নীল গেঞ্জি (টি-শার্ট) পরিয়ে দেয়া হয়। নীল টি-শার্ট পরা থাকলেই আফ্রীন বুঝতে পারেন এরা তার লোক। সেখান থেকে তাদের জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পাঠানো হয়। এরপর টিয়া কালারের গেঞ্জি পরিয়ে জর্ডানের নাগরিকের হাতে তুলে দেয়া হয়। সেখান থেকে তাদের নেয়া হয় লিবিয়া। সেখানে যাওয়ার পর পরানো হয় সাদা-কালো গেঞ্জি। লিবিয়ার এয়ারপোর্টে সজীব, মানিক ও জাফর অবস্থান করেন। সাদা-কালো গেঞ্জি দেখলেই তারা বুঝতে পারেন এই ব্যক্তিরা তাদের মক্কেল। পরে তাদের লিবিয়া থেকে নৌকা বা স্পিডবোটে মাল্টা হয়ে অবৈধভাবে ইতালি পাঠানো হয়।

তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় গ্রেফতার সুজন ডিবিকে জানায়, তার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের জগন্নাথপুরে। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। তার ছোট ভাই সজীব লিবিয়ায় থাকে। তার মাধ্যমে ভৈরবের জগন্নাথপুরের সজল, লক্ষ্মীপুর গ্রামের বিজয় ও নুর আলীপুরের ইছার উদ্দিন লিবিয়ায় গিয়েছেন। এদের মধ্যে বিজয় ও ইছার উদ্দিন নিখোঁজ আছেন। সজল ওই হামলায় আহত হয়েছেন। পাচারকারী চক্রের সদস্য জাফরের মাধ্যমে সজীব এই তিনজনকে লিবিয়ায় নিয়ে যান। এর আগেও জাফরের মাধ্যমে অনেক লোক পাঠানো হয়েছে।

সিআইডি ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, লিবিয়ার ওই ঘটনায় ২৫ মামলায় এ পর্যন্ত ১৭১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেফতার ৪২ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, মানব পাচারের সঙ্গে দেশের ১৫ জেলার ১৪ চক্রের ৩ শতাধিক ব্যক্তি জড়িত। জেলাগুলো হচ্ছে, ঢাকা, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল ও বরগুনা। এদের মধ্যে, রাজধানীতে মানব পাচারে মো. কামালউদ্দিন ওরফে হাজী কামাল (গ্রেফতার), খালিদ চৌধুরী, আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় আছে। এছাড়া মানব পাচারে পুরানা পল্টনের স্কাই ভিউ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক শাহীন বাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদারীপুরে মানব পাচারে সক্রিয় আছেন নূর হোসেন শেখ, নজরুল, রবি, জুলহাস শেখ, মিরাজ হাওলাদার, রাসেল মীর, রাজন ওরফে বুলেট, মোমিন, ইলিয়াছ মীর, জাকির মিয়াসহ ২৫ জনের একটি চক্র। গোপালগঞ্জে সক্রিয় আছে রব মোড়লের নেতৃত্বে, কুষ্টিয়ায় মো. কামালের নেতৃত্বে, ফরিদপুরের বক্স সরদারের নেতৃত্বে, নড়াইলে মোক্তার মোল্লার নেতৃত্বে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শাওন ও জাফর ইকবালের নেতৃত্বে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রফিকুল ইসলাম (সেলিম) ও হোসাইনের নেতৃত্বে, কুমিল্লার সনাতন দাশ ওরফে দাদা, শরীফ হোসেনের নেতৃত্বে, শরীয়তপুরের রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, বরগুনায় সজল ও ইদ্রিস আলীর নেতৃত্বে, নোয়াখালীতে রুবেল মির্জা, নাসির উদ্দিন মির্জা ও রিপন মির্জার নেতৃত্বে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। হেলাল মিয়া, খবির উদ্দিন ও শহিদ মিয়ার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে একটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। আশিকের নেতৃত্বে একাধিক চক্র মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মানব পাচারে সক্রিয় আছে।

গত বছরের নবেম্বরে লিবিয়ায় মানব পাচার মামলার ৬ পলাতক আসামিকে ধরতে ইন্টারপোলের সাহায্য চেয়েছিল সিআইডি। সিআইডির অনুরোধে রেড নোটিস জারি করে বাংলাদেশ পুলিশ। নোটিস দেয়ার দেড় মাসের মধ্যে দুই বাংলাদেশি মানব পাচারকারী গ্রেফতারও হন। এরপর ৬ মাস কেটে গেলেও বাকি চার আসামি মিন্টু মিয়া, স্বপন, নজরুল ইসলাম মোল্লা ও তানজিরুলের খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।

জানা গেছে, লিবিয়া ট্র্যাজেডির পরও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। গত ২১ জুলাই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। এর আগে গত ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ২৬৪ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। গত ২৮ ও ২৯ জুন নৌকায় অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪৩ জন নিখোঁজ বা মৃত্যু হয়। ২০১৪ সাল থেকে এ পথে ইউরোপে যেতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের ২০ হাজারের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরেই মারা গেছেন অন্তত ৩৫০ জন। ভূমধ্যসাগরের এ জলপথকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য ‘বিপজ্জনক পথ’ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ