ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রলোভনের ফাঁদে তরুণীরা

প্রকাশনার সময়: ০৮ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০৩
প্রতীকী ছবি

সারাদেশেই গত কয়েক মাসে কিশোরী ও তরুণীদের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এদের একটি বড় অংশ প্রেমের টানে ঘর ছেড়েছে। কেউ কেউ আবার টিকটকে অভিনয় কিংবা বিদেশে ভাল চাকরির প্রলোভনে এ ফাঁদে পা দিয়েছে। এদের বেশিরভাগই প্রতারণার শিকার হয়েছে। বেশকিছু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পাচার ও খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে। যদিও এ বিষয়ে প্রকাশ্য বলতে তারা নারাজ।

এমনকি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তবে তাদের দাবি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এ সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ নেই। সর্বশেষ পল্লবীর নিখোঁজ তিন বান্ধবীকে উদ্ধার করতে এ ধরনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।

সমাজ বিজ্ঞানীরা জানান, করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় বছর স্কুলে পড়াশোনা বন্ধ ছিল। পড়া, পরীক্ষা ও কোচিং সবই চলছে অনলাইনে। স্বাভাবিক কারণেই পড়ুয়াদের সবার হাতে উঠেছে স্মার্ট মোবাইল ফোন। পড়ার ফাঁকে শিক্ষার্থীরা অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন গেমে। অনেকে আবার জড়িয়ে পড়ছে চেনা-অচেনা বন্ধুদের সঙ্গে নিত্যনতুন সম্পর্কে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয়ের সূত্র ধরে বিপুলসংখ্যক কিশোরী অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রেমিকের হাত ধরে ঘর ছেড়েছে। ওই কিশোরীদের খোঁজ করতে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ পুলিশ কর্মকর্তাদের। উদ্ধার করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, অনেকেই রীতিমতো বিয়ে করে সংসার পেতেছে। কেউ কেউ গর্ভধারণও করেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, ঘর ছেড়ে পালানোদের তালিকায় শহরের কিশোরীদের সংখ্যা কিছুটা বেশি হলেও গ্রামের কিশোরীরাও এ পাল্লায় খুব বেশি পিছিয়ে নেই। নিখোঁজ হওয়া কিশোরীদের একটি বড় অংশই সর্বনাশা এ পথে পা দিয়েছে অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, নিখোঁজ কিশোরীদের উদ্ধার অভিযানে নেমে দেখা গেছে, মোবাইলের নেশাতেই তারা বিপথগামী হয়েছে। অনলাইনে পড়ার জন্য অভিভাবকরা স্মার্ট মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছেন। আর ছাত্রীদের একাংশ সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢুকে অচেনা বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছে। মূলত ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীদের একটি অংশের মধ্যে ভার্চুয়াল বন্ধুত্বকে ‘অ্যাকচুয়াল’ সম্পর্কে রূপান্তরের প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।

নিখোঁজ কিশোরীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জেনেছে, অনলাইনে পড়াশোনার নাম করে যে মেয়ে ফেসবুকে মেতে থাকত, বেশিরভাগ অভিভাবক তা আগে খেয়াল করেননি। তাদের কিশোরী মেয়ে কারো সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কে জড়াতে পারে এ চিন্তা তাদের মাথাতেই আসেনি।

কয়েকজন অভিভাবক জানান, বখাটে ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি পরিবারের লোকজন জানার পর মেনে না নেয়ার কথা বললেই সুযোগ বুঝে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়। এদের কেউ কেউ পুলিশের সহযোগিতা এবং পারিবারিক উদ্যোগে সন্তানদের খুঁজে বের করেছেন। অনেক অভিভাবক কন্যার অবস্থান জানতে পারলেও আইনি জটিলতা, সামাজিক সম্মানহানি, পারিবারিক অসমতা এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেননি। এমনকি অনেক অভিভাবক সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছেদ করেছেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, কিশোরীদের ঘর ছেড়ে পালানোর বেশিরভাগ ঘটনা প্রেম সম্পর্কিত হলেও এর সঙ্গে পাচার, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি ও মাদক বহনসহ নানা অপরাধ বৃদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে। সন্তান বিপথগামী হওয়ার জেরে অনেক পরিবার পুরোপুরি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। যার চাপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমাজের ওপর পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। তা না হলে আগামীতে বিপদ আরো বাড়বে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানায়, কিশোরী নিখোঁজের বেশকিছু ঘটনার সঙ্গে পাচারকারীদের যে যোগসূত্র পাওয়া গেছে, তা নিবিড়ভাবে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ চক্রকে চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের মুখোমুখি করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এছাড়া অবুঝ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীরা যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতির সূত্র ধরে ভুল পথে পা দিতে না পারে এজন্য প্রযুক্তিগত মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে। পথঘাট ও যানবাহনসহ যে কোনো স্থানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের সন্দেহজনক চলাফেরা দেখামাত্র তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং প্রয়োজনে অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিশোরী নিখোঁজের ঘটনায় তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস শুরুর পর বেশকিছু নারী পাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর-তরুণীদের টার্গেট করে অনলাইনে একাধিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছে। নানা প্রলোভন ও ছলচাতুরি করে তারা অবুঝ শিশুদের সে ফাঁদে ফেলে ঘরছাড়া করছে। তরুণীদের ভালো কাজের প্রলোভন দেখিয়ে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে নিয়ে গিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ হয় এমন জায়গায় বিক্রি করে দেয়ার টার্গেটে রয়েছে।

এছাড়া আরো একাধিক চক্র কিশোরী ও তরুণীদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাদের ঘরের বাইরে এনে তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিচ্ছে। এমনকি সুযোগ বুঝে ধর্ষণ করছে। যার ভিডিও ধারণ করে পরবর্তীতে অভিভাবকদের ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বাধা দিতে গিয়ে খুন-জখমের মতো ঘটনাও ঘটেছে।

নানা প্রলোভনে কিশোরীদের ঘর থেকে বের করে এনে অপহরণের নাটক সাজিয়ে অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায়েরও বেশ কিছু ঘটনা এরইমধ্যে ঘটেছে। এসব ঘটনায় কেউ কেউ থানা পুলিশকে অবহিত করলেও সামাজিক মান-মর্যাদার ভয়ে বেশিরভাগ ভিকটিম পরিবার বিষয়টি গোপন করছে।

গোয়েন্দারা জানান, কিশোরী পাচার, অপহরণ ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সঙ্গে জড়িত সংঘবদ্ধ চক্রগুলো প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট পারদর্শী। যে কারণে তাদের চিহ্নিত করতে গিয়ে র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, এসব ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের সঙ্গে একপক্ষীয় যোগাযোগ তৈরি করে। ফলে তারা তাদের সময় সুযোগমতো যোগাযোগ করতে পারে। ভিকটিম কেউ উদ্ধার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে পুলিশ তাদের জালে আটকাতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া বেশকিছু ক্ষেত্রে তারা থার্ড-মিডিয়ার মাধ্যমে টার্গেটকৃত কিশোরী ও তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। পুলিশ ওই থার্ড-মিডিয়াকে গ্রেফতার করতে পারলেও তার নেপথ্যে থাকা চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ