ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১, ২৫ রবিউস সানি ১৪৪৬

ডেমু ট্রেন: ৮ বছরে গচ্চা সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা

প্রকাশনার সময়: ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৫:৫২
সংগৃহীত ছবি

‘ডেমু ট্রেন’ প্রকল্পে ৮ বছরে কার্যত সাড়ে ৬শ’ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। যাত্রীসেবার মান বাড়াতে ২০১৩ সালে ২০ সেট ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডেমু ট্রেন) কিনেছিল বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে ব্যয় হয়েছিল ৬৫৪ কোটি টাকা। ৯ বছরের মাথায় ২০ সেট ট্রেনের মধ্যে সচল আছে মাত্র তিনটি। বাকি ১৭ সেট দীর্ঘদিন ধরে ওয়ার্কশপে বিকল হয়ে পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় এসব ট্রেন সচলও করতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ডেমু ট্রেন কেনার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই না করায় এবং কেনার প্রক্রিয়ায় নীতিগত কিছু ভুল থাকায় এমন অবস্থা হয়েছে বলে দাবি কর্তৃপক্ষের। এর পেছনে আর বাড়তি টাকা খরচ করতে রাজি নয় রেলপথ মন্ত্রণালয়।

এদিকে, যে তিন সেট ডেমু ট্রেন সচল আছে সেগুলোতেও রয়েছে যান্ত্রিক ত্রুটি। যদিও প্রকল্পের শুরুতে প্রতিটি ট্রেনের মেয়াদকাল ধরা হয়েছিল ৩০ বছর। ট্রেনগুলো ২০ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচলের কথা থাকলেও গড়ে চলেছে ৯০ কিলোমিটার। সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি সংযোজন করে বিকল ট্রেনগুলো কম দূরত্বে চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেমুর জন্য স্পেশাল ডক-ইয়ার্ড ও স্টেবল লাইনের দরকার ছিল। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মীদের যে প্রশিক্ষণ দরকার, তাও ছিল না। সবমিলিয়ে দ্রুত চলাচলের জন্য রেল কর্তৃপক্ষ ভালো উদ্যোগ নিলেও কিছু কিছু ভুলের কারণে এখন লোকসানের মুখে পড়েছে। অথচ ২০টি ট্রেনের টাকা দিয়ে সাধারণ ট্রেনের ১২০টি এসি বগি কেনা যেত। প্রতিটি এসি বগি থেকে বছরে গড়ে আড়াই কোটি টাকা আয় হতো।

যাত্রীদের অভিযোগ, দ্রুত সেবার পরিবর্তে ডেমু ট্রেন যেন এক বিড়ম্বনার নাম। মাঝে মধ্যেই নানা সমস্যায় মাঝপথে এসব ট্রেন বিকল হয়ে পড়ছে। তখন অন্য ট্রেন দিয়ে টেনে ওয়ার্কশপে নিতে হয়। ফলে এসব ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। গাজীপুর-বিআইডিসি পর্যন্ত গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে- আবার পেছনে ফিরে এসেছে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে। তারা আরো বলেন, ডেমু ট্রেন পুরোপুরি অচল, এটিতে উঠলে মনে হয় দোজখে উঠেছি। ট্রেনে উঠলেই গরম অসম্ভব লাগে। আমাদের দেশের জন্য এ ট্রেনটি উপযোগী নয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১১ সালে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর সঙ্গে শুল্ক-কর এবং ৩০ জন কর্মকর্তার বিদেশে ভ্রমণ-ভাতার খরচ যোগ হয়। এতে এই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকায়। পরে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগর রুটে বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়।

এসব ট্রেন মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের স্বল্প দূরত্বে (২০ কিলোমিটার) যাতায়াতের জন্য কেনা হয়েছিল। অথচ অন্য প্রতিটি রুট গড়ে ৯০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ফলে উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই একের পর এক ট্রেন বিকল হতে শুরু করে। চীন থেকে কেনা এসব ডেমু ট্রেন ছিল সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির। প্রতিটি ট্রেনের মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন পর এক এক করে ট্রেনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দেশে এই ধরনের ট্রেন সচলে ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে ট্রেন নষ্ট হলে সারানোর ব্যবস্থাও নেই। সবমিলিয়ে ডেমু ট্রেনগুলো এখন রেলওয়ের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডেমু ট্রেনের দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন এবং মাঝখানে একটি বগি থাকে। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিন অংশেও যাত্রী বহন করা যায়। প্রতিটি ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারেন। যখন ডেমু ট্রেনগুলো উদ্বোধন করা হয় তখন প্রতিটি ডেমুতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী যাতায়াত শুরু করে। এর মধ্যে স্বল্প দূরত্বের এসব ট্রেন এক থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে। মূলত এসব কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে। অন্যথায় এ ধরনের ট্রেনের ইঞ্জিনে পাঁচ বছরের আগে হাত দেয়া লাগে না। মেরামত করে ২৫ থেকে ৩০ বছর চালানো যায়।

কমলাপুর রেলস্টেশনসংলগ্ন ডেমু ট্রেনের ওয়ার্কশপ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্কশপের ভেতর এবং বাইরে বিকল হয়ে পড়ে আছে ১০টি ডেমু ট্রেন। এসব ট্রেনের অধিকাংশের দরজা-জানালা ভাঙা। আসনের ওপর কয়েক স্তর ধুলাবালির আবরণ। কয়েকটি ট্রেনে লতাপাতা জন্মেছে।

একই দিন দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে আসে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরগামী দুটি ডেমু ট্রেন। এসব ট্রেনে নির্দিষ্ট গন্তব্যের যাত্রীরা ওঠেন। কিন্তু ট্রেনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট। এছাড়া জানালাগুলো খুবই ছোট। বাইরে থেকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ট্রেনে প্রবেশের সুযোগ নেই। ফলে গরমে অনেক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন।

নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার জন্য ট্রেনে ওঠেন ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, এই ট্রেনে যাতায়াতে সময় এবং ভাড়া কম লাগে। কমবেশি এই ট্রেনেই যাতায়াত করি। তবে যেদিন ডেমু ট্রেনে উঠি সেদিন গরমে হাঁসফাঁস লাগে। আসন খালি থাকলেও ভেতরে বসি না। আলো-বাতাসের জন্য দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করি।

একই কথা বলেন গাজীপুর সদরের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, কমলাপুর থেকে গাজীপুর বাসে যাতায়াত করতে তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু ডেমু ট্রেনে এক ঘণ্টার মধ্যে যাওয়া যায়। তাই গরমে কষ্ট হলেও এই ট্রেনে যাতায়াত করি। তবে যাত্রীসেবার নামে রেলওয়ের এই ধরনের তামাশা বন্ধ করা জরুরি।

কমলাপুর রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার জানান, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর রুটে যে দুটি ট্রেন চলাচল করে সেগুলো ভোর সাড়ে ৫টা ও দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে কমলাপুর ছেড়ে যায়। এ সময় ডেমুতে যাত্রী সংখ্যা কম থাকে। ফলে চলাচলে তেমন সমস্যা হয় না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর রুটের একজন বুকিং সহকারী বলেন, প্রায় দিনই দুপুরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ডেমুতে গড়ে তিনশ’র মতো যাত্রী পরিবহন করা হয়। ভোরে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকে। এছাড়া ডেমুতে ত্রুটি বা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তখন ট্রেনের টিকিট ফেরত নেয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।

রেলওয়ের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরে জুন পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন করে ডেমু ট্রেন দিয়ে রেলওয়ে আয় করেছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তবে ডেমু ট্রেন পরিচালনায় ব্যয় প্রায় একই পরিমাণ। এই অর্থ ব্যয় হয়েছে জ্বালানি ও স্টাফদের বেতন বাবদ। ডেমুর আয়-ব্যয় সমান। ফলে যে ৬৫৪ কোটি টাকা খরচ করে এই ট্রেন কেনা হয়েছে, সেই টাকা পুরোটাই জলে গেছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ডেমু ট্রেন যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ শহরে সার্কুলার ট্রেন হিসেবে ডেমু যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে পারত।

তিনি বলেন, রেলওয়ের কর্মকর্তারা এই ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করেননি। তাই ট্রেনগুলো দেশে আনার পর দেখা গেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ি আড়াই ফুট উঁচু। এতে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওঠা-নামায় সমস্যা পড়তে হয়। ট্রেনের ভেতরের কাঠামোও যাত্রীবান্ধব ছিল না। ফলে ডেমু জনপ্রিয়তার বদলে তার চাহিদা নষ্ট করেছে।

ডেমু ট্রেনগুলো মেরামতের দায়িত্বে রয়েছেন রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। রেলপথ মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব ড. মো. খালেদ হোসেন সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনিও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

চীনের তৈরি ডেমু ট্রেনগুলো কেনার প্রক্রিয়া ঠিক ছিল না বলে মন্তব্য করেন রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, এসব ট্রেনের পেছনে বাড়তি খরচে আর আগ্রহী নয় মন্ত্রণালয়। নীতিগত কিছু ভুলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন যে তিন সেট ডেমু ট্রেন চলছে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ও জয়দেবপুর রুটে, সেগুলোতেও আছে যান্ত্রিক ত্রুটি।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ