চোখে জল, আদালত থেকে হাউমাউ করে মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বের হলেন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নির্যাতনের শিকার সেই নারী।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এ রায়ে আমি খুশী নই, ওরা যেভাবে আমার উপর নির্যাতন চালিয়ে তা মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিল তাতে আমার আশা ছিল আদালত ওদের ফাঁসি দিবে।”
‘আদালত আজ ওদের ফাঁসির রায় দিলে আমার কাঁদতে হতো না’ বলেন ওই নারী।
আজ সোমবার বেলা ১১টায় নোয়াখালীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক জয়নাল আবেদীন মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আদালত অভিযুক্ত ওই দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একইসঙ্গে উভয় আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। ১ বছর পর এ চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা হলো।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার হোসেন ওরফে দেলু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোহাম্মদ আলী ওরফে আবুল কালাম।
আদালত প্রাঙ্গণে নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভা প্রধান তাসলিমা আক্তার বলেন, এই ঘটনাটি সারাদেশের আলোচিত ঘটনা। আজকে যে রায় দিয়েছে তাতে আমরা খুশি। আমরা চাই আর কোনো নারী যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হন।
এ সময় রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ লাবলু, বাদী পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোল্লা হাবিবুর রসুল মামুন ও আসামি পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন বাদল।
মামলায় রাষ্ট্র পক্ষের কৌঁসুলী পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ লাবলু জানান, আলোচিত গৃহবধূ ধর্ষণ মামলাটিতে আমরা বিজ্ঞ আদালতে স্বাক্ষী উপস্থাপন, জেরা ও জবানবন্দি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি। এ মামলায় রাষ্ট্র পক্ষে ১২জন ও আসামীর পক্ষে ৩ জন সাফাই স্বাক্ষী প্রদান করেন। বিজ্ঞ আদালত দুই আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং একই সাথে উভয় আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো ৩মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আদালত সূত্রে জানা যায়, এর আগে, গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি আসামীদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। পরে গত ১৮ আগস্ট আসামিদের উপস্থিতিতে বাদীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, ওই নারীকে দুই দফায় ধর্ষণের অভিযোগে ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর বেগমগঞ্জ থানায় দু’জনকে আসামি করে এ ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। পরে মামলাটি পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয়। পিবিআই আদালতে মামলার চার্জশীট দেয় ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর।
ধর্ষণ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে আজকে রায় প্রদান করা হয়েছে। তবে, একই ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে আরো ২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ২০২০ সালে বেগমগঞ্জের একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে স্থানীয় সন্ত্রাসী দেলোয়ার বাহিনী স্বামীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এতে ব্যর্থ হয়ে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে প্রহার করে। সেই দৃশ্য মোবাইলফোনে ধারণ করেন অভিযুক্তরা। আহত ওই নারী চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে জেলা সদরে তার বোনের বাসায় পালিয়ে যান।
তিনি আরও জানান, সেখানে গিয়েও অভিযুক্তরা তার কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং তাদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেন। গৃহবধূ এতে রাজি না হওয়ায় আগের ধারণ করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে ঘরে ঢুকে এক নারীকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন দেলোয়ার বাহিনীর সদস্যরা। ঘটনার ৩২ দিন পর ৪ অক্টোবর সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করা হয়। ঘটনার পর সন্ত্রাসীদের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো ওই নারীকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বেগমগঞ্জ মডেল থানায় ধর্ষণ, নির্যাতন এবং পর্নোগ্রাফি আইনে তিনটি মামলা করেন নির্যাতিত নারী।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ