বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট আবারো ভাঙনের মুখে পড়ল। এরই মধ্যে জোট থেকে একে একে বেরিয়ে গেছে ইসলামি ধর্মভিত্তিক দলগুলো। এখন বাকি শুধু জামায়াত। যদিও জামায়াতের নেই নিবন্ধন। তাদেরও জোট থেকে বের করে দিতে পারে এমন দাবি জোরালো হয়েছে বিএনপিতে। সব মিলিয়ে জোট রাজনীতি নিয়ে রীতিমতো নিশ্চুপ বিএনপি।
জোটের সঙ্গীরা বেরিয়ে সরকারের সঙ্গে একধরনের সংখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার পরই গ্রেফতারকৃত নেতারা একে একে কারাগার থেকেও মুক্তি লাভ করেন। তবে নেতাকর্মীদের মুক্তি দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখনো স্পষ্ট নয়। এমনকি কোনো গ্রিন সিগন্যালও দেয়া হয়নি। তবে জোটের বাইরে থাকা ইসলামি দলগুলোও একমঞ্চে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পক্ষে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে বা এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা।
বিএনপির অভিযোগ, জোট ভাঙার পেছনে সরকারের ভূমিকা রয়েছে। সরাসরি সরকারের চাপে পড়েই তারা জোট ছেড়েছে। জোট ছাড়ার পরই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে দলগুলোর। এদিকে, জোট ছাড়ার আগে থেকেই বিএনপির শরিক দলের নেতাসহ অনেকেই আওয়ামী লীগের নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে আসছিল বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসলামি শাসনতন্ত্র কোনো জোটবদ্ধ না হয়ে বর্তমানে আলাদা রাজনীতি করছে। তবে ভবিষ্যতে বড় দুই দলের বাইরে তৃতীয় শক্তি সৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনাও রয়েছে ইসলামি ধারার দলগুলোর মধ্যে। পাশাপাশি হেফাজতে ইসলামও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় একটি ফ্যাক্টর। বিগত নির্বাচনগুলোতে ভোটের হিসাবে ইসলামি দলগুলো আগের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছে। এর পাশাপাশি আফগানিস্তানে নতুন করে তালেবানের উত্থান ঘটেছে। তাই ইসলামি ধারার এ দলগুলো নতুন জোট গঠন করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না বলে মনে করছেন তারা।
জানা গেছে, দীর্ঘ ২২ বছরের সম্পর্ক ত্যাগ করে ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। এর আগে গত ১৪ জুলাই কওমি আলেমদের পুরোনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। তারও আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালের ৭ জুন বিএনপি জোট ছেড়ে যায়। আর শায়খুল হাদিসের দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়ে তারও অনেক আগে। এখন শোনা যাচ্ছে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অন্যান্য ইসলামি ধারার দলের ভগ্নাংশও।
বিএনপির জোট ভাঙার কারণও তুলে ধরেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ একাধিক নেতা। তারা বলেন, একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে ওঠে আদর্শের ভিত্তিতে, জনগণের কল্যাণের কথা ভেবে। বিএনপির ভেতর দুটোই অনুপস্থিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে টাকা দিয়ে দল গড়েছেন। কিন্তু ভিত্তি না থাকায় হারিয়ে গেছে দলগুলো। এটা জনগণ যেমন বুঝেছে, বিএনপির শরিকরাও বুঝেছে।
আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা আরো বলেন, একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের বড় দুর্বলতা জোট ভাঙা। এতে স্পষ্ট হয়েছে বিএনপি অন্তসারশূন্য। দেরিতে হলেও এটা বুঝছে পেরেছেন শরিকরা। ২০ দলীয় জোট নেতারা বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি গণমুখী ও উন্নয়নমুখী, বিএনপির রাজনীতি দুর্নীতিমুখী।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ভাঙার বড় কারণ জামায়াতের সঙ্গ তারা চায় না। দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট বুঝতে পেরেছেন বিএনপির জোট নেতারা।
তিনি বলেন, বিএনপি জোটের অনেক নেতা আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ও উন্নয়নমুখী রাজনীতির প্রতি আস্থা রেখে নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে আসছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই নানাজন ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে। ছোটখাটো রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সংগঠনের অনেকেই কাছে আসতে চেয়েছেন। তবে আমাদের ১৪ দল একটি আদর্শিক জোট। এই জোটের পরিসর আর বাড়বে না। নতুন করে কারো জোটে ঢোকার সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য ফারুক খান বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নেতারা ‘আমদানি’ করা রাজনীতি সঠিক নয় মনে করে জোট ত্যাগ করতে শুরু করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া দুর্নীতির দায়ে বিদেশে পলাতক। তার সিদ্ধান্ত ও রাজনীতিতে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন শরিকরা।
ফারুক খান বলেন, শরিকরা বুঝতে পেরেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতি গণমুখী। বিএনপির সঙ্গে থেকে তারা গণমুখী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। জনগণের কল্যাণে কাজও করতে পারছে না। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে জোট ছেড়ে যাচ্ছে তারা।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে সভাপতিম-লীর অপর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, জোটের রাজনীতি যদি হয় শুধু ক্ষমতার, তখন জোট টিকতে পারে না। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা গ্যাপগুলো দেখেছেন। তাই তারা বেরিয়ে যাচ্ছেন। আদর্শ মজবুত না হলে জোট-দল কিছুই টেকে না। আর জামায়াত তাদের ছাড়েনি অথবা তারা জামায়াত ছাড়েনি। দুই দলের আদর্শই এক। খেলাফত মজলিস একক, না জোটগতভাবে রাজনৈতিক করবে কিনা জানতে চাইলে দলের আমির মাওলানা ইসহাক নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা ভবিষ্যতে আর কোনো জোটে যাব না। বিএনপি জোটেও আর ফিরব না। এখন আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে দলের কাজ করব।
তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলোর জোট ডাকলেও যাব না। আমাদের আগে থেকেই সিদ্ধান্ত ছিল কারো সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করব না। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে খেলাফত মজলিস জাতির প্রয়োজনে সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। আগামীতেও এককভাবে করব।
খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ও হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরী সেক্রেটারি আবুল হাসানাত আমিনী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ইসলামি দলগুলোয় মৌলিক কোনো বিভেদ নেই। সবাই ইসলামি হুকুমত কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করছে। লক্ষ্য এক হলেও পদ্ধতিগত কিছু গরমিল রয়েছে। এই গরমিল দূর করতে হবে। একেই অনেকে বিভেদ ভাবেন; যা ঠিক নয়। রাজনৈতিকভাবে ইসলামি দলগুলো পৃথক পথ অবলম্বন করলেও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনে সব সময় ঐক্যবদ্ধ। তবে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কখন, কোন দিকে মোড় নেয় তা বলা কঠিন।
ইসলামি দলগুলোকে একমঞ্চে আনার ক্ষেত্রে আপনার দল কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সব সময় ঐক্যের পক্ষে। আমরা মনে করি ইসলামি শক্তি একমঞ্চে এলে ইসলামি জনতার হৃদয়ে আবার আশার আলো জ্বলে উঠবে। দেশে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। ২০০১, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ সালে যখনই ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের লক্ষ্যে বৃহত্তর ঐক্যের প্রচেষ্টা চালিয়েছি, সফল হয়েছি। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন, নির্বাচনের বেলায় ইসলামি দলগুলোয় ঐক্যের প্রবণতা কম, এটা দুঃখজনক। বিগত নির্বাচনের আগেও ইসলামি ঐক্যজোট ঐক্যের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। আশা করি, ভবিষ্যতে ইসলামি দলগুলো আবারো একই প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হবে।
জোট রাজনীতি নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ইসলামি দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক আমরা সবসময় চাই। ইসলামি দলগুলো এক হয়ে ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যাক এটা আমরাও চাই। এখন বিএনপি জোট থেকে কেবল আসল তারা। বিভিন্ন সময় বিএনপি বা অন্য দলে যারা ছিল তারা কোন উদ্দেশ্যে আসছে, তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, ভবিষ্যতে ইসলামকে এগিয়ে নিতে চায় কিনা সেটা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। আগে তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার করতে হবে। তারপর যদি পরিবেশ পরিস্থিতি হয় তাহলে অবশ্যই ঐক্য হতে পারে। কারণ আমরা ঐক্য বিশ্বাসী। সময়ের ব্যবধানে সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে।
ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ডাকলে যাবেন কিনা জানতে চাইলে আতাউর রহমান আরো বলেন, আওয়ামী লীগ প্রায় ৩০০ আসনেই জিতে গেছে। এখন ডাকবে কেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক ও আদর্শগত মিল নেই। ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করি আমরা। ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আদর্শগত দিক থেকে বিপরীতমুখী। তাদের সঙ্গে যোগ দিলে আদর্শগত দিক দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাব। ঠিক তেমনি তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিএনপি জোটে যোগ দিয়ে যেমন ক্ষতি হয়েছে জোটের শরিকদের। এজন্য কোনো চেতনার শক্তি বা জাতীয়তাবাদী শক্তির কারো সঙ্গে যায়নি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিÑ ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি আমরা। ইসলামের পক্ষে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক। ইসলামকেই ক্ষমতায় নিয়ে যেতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামের আদর্শের মাধ্যমেই মানুষ অধিকার ফিরে পেতে পারে। একটা কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা যেতে পারে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ