হারুন অর-রশিদ নামে এক ব্যক্তি রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় অভিযোগ করেন, তার ছেলে ফরহাদ হোসেনকে অপহরণ করেছে দুর্বৃত্তরা। মুক্তিপণ হিসেবে সাড়ে তিন লাখ টাকা না দেয়া হলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে।
তার অভিযোগের সূত্র ধরে তদন্তে নেমে অন্যরকম এক কাহিনি জানতে পারেন গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা কারবারিরা এখন নতুন এক কৌশল ব্যবহার করছে। তারা কক্সবাজারের টেকনাফে গিয়ে ইয়াবার চালান আনার সময় দলের একজনকে ‘জিম্মি’ হিসেবে রেখে আসে। পাইকারি কারবারিরা পুরো টাকা না পাওয়া পর্যন্ত তাকে আটকে রাখে। আর টাকা না পেলে তাকে নির্যাতন করে ভিডিও কলে পরিবারের সদস্যদের দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হয়। এভাবে ফরহাদকে আটকে রেখেছিল মাদক কারবারিরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্র জানায়, হাতিরঝিলের এক যুবককে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের অভিযোগে শনিবার টেকনাফ থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো- সাব্বির আহমেদ, নুরুল আমিন, সাদ্দাম হোসেন। এ সময় তাদের হেফাজতে থাকা অপহৃত তরুণকেও উদ্ধার করা হয়।
তাদের তথ্যে রোববার হাতিরঝিল থেকে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সামির আহাম্মেদ ওরফে লাদেনকে গ্রেফতার করা হয়।
এই চক্রটি ইয়াবার কারবারে জড়িত বলে জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইয়াবা কারবারে বেশি টাকা লগ্নি না করার উপায় হিসেবে বিক্রি করে টাকা পরিশোধের কৌশল নিয়েছে বিভিন্ন চক্র। সাধারণত তারা ইয়াবার চালানের মোট দামের একাংশ নগদ দেয়। আবার কখনো পুরোটাই বাকি রাখে। টাকা দেয়ার নিশ্চয়তা হিসেবে নিজের দলের কাউকে ইয়াবার কারবারিদের জিম্মায় দিয়ে আসে।
গ্রেফতার লাদেন জানিয়েছে, সে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার কাজ করে। তার পরিচিত বড়ভাই পারভেজ পোস্তগোলা এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে। সে ইয়াবা আনার জন্য লাদেনকে কক্সবাজারে মুজাহিদ নামে একজনের কাছে পাঠায়। তবে মুজাহিদ তার হাতে ইয়াবা না দিয়ে আরেক সদস্য জাহিদের মাধ্যমে দুই হাজার ইয়াবা পাঠিয়ে দেয়।
এ সময় তারা তাদের আটকে রাখে। তাকে বলা হয়, ইয়াবার টাকা হাতে পেলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। এক পর্যায়ে সে অনেক অনুরোধ করে টাকা পরিশোধের শর্তে ঢাকায় ফিরে আসে। কিন্তু এখানে এসে পারভেজের ফোন বন্ধ পায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা জোগাড় করতে না পেরে সে ইয়াবা কারবারিদের দেয়া বিকল্প পথ বেছে নেয়। এলাকার ছোট ভাই ফরহাদকে বেড়ানোর কথা বলে টেকনাফে নিয়ে যায় সে। সেখানে তাকে সাদ্দাম, মুজাহিদ, নূরে আলম ও সাব্বিরের জিম্মায় দিয়ে সে আবার ঢাকায় চলে আসে। তখন টাকা উদ্ধারে ইয়াবা কারবারিরা ফরহাদের বাবার কাছে সাড়ে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়।
ডিবির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা বলেন, উদ্ধারের পর আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে ফরহাদ হোসেন জানায়, লাদেন তাকে কোনো খরচ ছাড়াই কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। এতে রাজি হয়ে গত ২ সেপ্টেম্বর সে রওনা হয়। সেখানে তাকে তিন-চারজন অচেনা লোকের হাতে তুলে দেয়া হয়। তার হাত-পা ও চোখ বেঁধে একটি ঘরে আটকে রেখে মারধর করা হয়। এর ১৫-২০ দিন পর সাদ্দাম নামে ওই দলের একজন ফরহাদের বাবাকে ভিডিও কল দিয়ে মুক্তিপণ চায়। এ সময় তাকে নির্যাতন করে ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখানো হয়। ফরহাদের বাবা তখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা পাঠান। শেষে ২ অক্টোবর রাতে টেকনাফের ছাবরাং এলাকায় নূরে আলমের বাসা থেকে তাকে উদ্ধার করে ডিবি।
ডিবি ও টেকনাফ পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা বা অন্য স্থান থেকে টেকনাফে যাওয়া ইয়াবা কারবারি ও সেখানকার স্থানীয় পাইকারি কারবারিরা সমঝোতার ভিত্তিতেই জিম্মি প্রথা চালু করেছে। অনেক সময় দুই পক্ষের কথা অনুযায়ী কাজ করায় এটা নিয়ে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায় না। অর্থাৎ একপক্ষ ফিরে গিয়ে টাকা পাঠায়, আর এখানকার জিম্মিকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে টাকা না পাওয়ায় আটকে মুক্তিপণ আদায় বা আদায়ের ঘটনাও কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে প্রকৃত ঘটনা না জানিয়ে জিম্মি হিসেবে মাদক কারবারিদের জিম্মায় দিয়ে আসা হয়। টেকনাফ থেকে চালান নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে বা ইয়াবার চালান জব্দ হয়। তখন টাকা দিতে না পারায় তার সঙ্গী ওখানে আটকে পড়ে।
টেকনাফ থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, মাঝে মধ্যেই অভিযোগ পাওয়া যায় যে, কোনো যুবককে অপহরণ করে আটকে রাখা হয়েছে। মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়েছে। তবে তাদের উদ্ধারে নেমে শেষ পর্যন্ত ইয়াবার কারবারের টাকা আদায়ে জিম্মি করে রাখার ঘটনা পাওয়া যায়। অনেক সময় পুলিশ উদ্ধারে অভিযানে নামতেই কারবারিরা জিম্মিকে ছেড়ে দেয়। গত এক বছরে প্রতি মাসেই এমন দুই-তিনটি করে ঘটনা ঘটেছে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ