ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

ই-কমার্সে গ্রেফতার আতঙ্ক

প্রকাশনার সময়: ০৩ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০৫

নিরাপদ ডট কম-এর পর ই-অরেঞ্জ। একে একে ইভ্যালি, ধামাকা। সবশেষ রিং আইডি। গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্তারা। গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছেন আরো অন্তত ৮ প্রতিষ্ঠানের কর্তারা। গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন তারা। সব মিলিয়ে হঠাৎ মুখথুবড়ে পড়েছে দেশের ই-কমার্স খাত। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে কমে গেছে বেচাকেনা। যদিও গ্রাহকদের আস্থা অর্জন ও ঘুরে দাঁড়াতে নীতিমালার আওতায় ব্যবসা করতে চাইছেন সৎ ব্যবসায়ীরা।

সংশ্লিষ্টদের দাবি, অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় ই-কমার্স জোরালো ভূমিকা রাখলেও দেশের কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা ও লুটপাটে গোটা খাতের অস্তিত্ব হুমকি মুখে পড়েছে। সরকারের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের অভাবে দুর্নীতিবাজ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ মানুষ মোটা অঙ্কের অর্থ খুইয়ে পুরোপুরি সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ফলে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

ই-কমার্সের মাধ্যমে কেনাকাটার জন্য ইতোমধ্যেই যেসব গ্রাহক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা দিয়েছেন প্রতারিত হওয়ার ভয়ে তারাও পণ্য না নিয়ে টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছেন। যৌক্তিক কারণে পণ্য সরবরাহে সামান্য দেরি হলে এখন প্রায় কেউই তা মানতে চাইছেন না। এতে দীর্ঘদিন ধরে সততা ও আস্থার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চরম বিপাকে পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে গ্রাহকদের যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তাতে এ খাতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে নিষ্ঠাবান-সৎ ব্যবসায়ীরা প্রণয়নকৃত নীতিমালার কঠোর নজরদারির মধ্যে সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ চাইলেও ঠকবাজরা এখনো উল্টো পথে হাঁটছে। তারা এর নানা ফাঁক-ফোকর গলে নতুন কৌশলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদ পাতার চেষ্টা করছে। আইনি ফাঁদে আটকে যাওয়া ইভ্যালি তাদের প্রতারণার শিকার লাখ লাখ গ্রাহককে কৌশলে মাঠে নামিয়ে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করছে। ইভ্যালির গ্রেফতারকৃত এমডি মোহাম্মদ রাসেল এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান (রাসেলের স্ত্রী) শামীমা নাসরিন জেল থেকে ছাড়া পেলে পুনরায় তাদের ব্যবসা চাঙ্গা করতে পারবেন এবং গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেবেনÑ এমন আশ্বাস দিয়ে তাদের সহযোগীরা প্রতারিত গ্রাহকদের রাজপথে নামানোর ফন্দি আঁটছে। তবে গোয়েন্দারা বিষয়টি আঁচ করতে পেরে এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে। এদিকে কিছুটা দেরিতে হলেও এ ব্যাপারে সরকারের টনক নড়েছে। চলমান এ সংকট কাটাতে এরই মধ্যে প্রায় দুই ডজন সন্দেহভাজন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহকের সঙ্গে ধোঁকাবাজি, হয়রানি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার রোধে সরকারের নয়টি দফতরকে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর এবং নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর ই-কমার্স কোম্পানির পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের নামে প্রতারণার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে। সংস্থাগুলো বিভিন্ন অভিযান ও তদন্তে প্রাপ্ত অপরাধের তথ্য নিজ নিজ আইনের আওতায় না পড়লে অন্য সংস্থাকে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ পাঠাচ্ছে। পরস্পর সমন্বয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন সব প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করায় এ খাতের প্রতারণা রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের প্রধান ও ডিআইজি মোহাম্মদ আবদুল্লাহেল বাকী জানান, ‘ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, আলাদীনের প্রদীপ, কিউকম, বুমবুমসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পণ্য বা সেবা বিক্রয় করা বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।

নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অনলাইন কেনাকাটায় ভ্যাট ফাঁকিসহ নানা আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তারা বেশ আগেই কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ভ্যাট আইনে বেশকিছু মামলা করা হয়েছে। ই-অরেঞ্জ, আলেশা মার্ট, পেপারফ্লাই, ইভ্যালিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া সন্দেহভাজন লেনদেনের কারণে আরো ১৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নজর রাখা হয়েছে। প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ শেষে তাদের তথ্য চেয়েও চিঠি দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, তাদের কাছে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ তারা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিললে দ্রুত ওইসব প্রতিষ্ঠানকে নজরদারির আওতায় নেয়া হচ্ছে। এদিকে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ই-কমার্সে প্রতারণা ও লুটপাট ঠেকাতে দায়সারা উদ্যোগ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা এবং এ খাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বেগবান করতে হলে সরকারকে বাস্তবমুখী কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা জানান, ই-কমার্স বাণিজ্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে ডিজিটাল ব্যবসায় শৃঙ্খলা আনার পাশাপাশি ভোক্তার আস্থা বৃদ্ধি ও অধিকার নিশ্চিতের কথাও বলা হয়। অথচ এর পরও ই-কমার্স খাতে ব্যাপক প্রতারণা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় এ নির্দেশিকা কাগজে-কলমেই গণ্ডিবদ্ধ রয়ে গেছে-যোগ করেন অর্থনীতিবিদরা।

প্রসঙ্গত, ৪ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের সই করা এই নির্দেশিকা জারি করা হয়। নির্দেশিকায় বলা হয়, প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সেখানে আরো বলা হয়েছে, সবধরনের ডিজিটাল ওয়ালেট, গিফট কার্ড, ক্যাশ ভাউচার বা অন্য কোনো মাধ্যম যা অর্থের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান নীতিমালা অনুসরণ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ব্যতিরেকে তৈরি, ব্যবহার বা ক্রয় বিক্রয় করা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে কোনো ধরনের অর্থ ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না।

ক্রেতাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো পণ্য বা সেবা কেনার জন্য বাধ্য করা যাবে না। সব ডিজিটাল কমার্স পরিচালনাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স, ভ্যাট নিবন্ধন, টিআইএন, ইউনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা পারসোনাল রিটেইলের অন্তত একটি গ্রহণ করতে হবে এবং তার মার্কেটপ্লেস বা সোশ্যাল মিডিয়া পেজে তা প্রদর্শন করতে হবে। স্বচ্ছতার জন্য ব্যবসায় লেনদেনসংক্রান্ত সব তথ্য অন্তত ৬ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হবে এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত যে কোনো সংস্থা চাহিবামাত্র তা সরবরাহ করতে হবে। ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সের মাধ্যমে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা নেটওয়ার্ক ব্যবসা পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া ডিজিটাল কমার্সে কোনো ভোক্তা প্রতারিত হলে তার অভিযোগ গ্রহণ এবং শাস্তির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে নির্দেশিকায়।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ