ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ আশ্বিন ১৪৩১, ২৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের সময় এখনই

প্রকাশনার সময়: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৪

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসা প্রত্যেকটি সরকার কার্যত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে অনভ্যস্ততা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যে ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছে, তা কেবল একজন নেতার দোষ নয়। বরং এটি একটি ব্যাপক এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা; যেখানে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং জনমতের প্রতি অশ্রদ্ধা পরিলক্ষিত হয়। এখানকার শাসকদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে, ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশের শাসকদের ক্ষমতা এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধের মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন কীভাবে করতে হয়, তা জানা প্রয়োজন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রকৃত বিকাশ সম্ভব নয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার জন্য তাঁর অনন্য অবদানকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়; তবে তাঁকে ক্ষমতায় আসার জন্য যে উদগ্রীবতা দেখাতে হয়েছে, তা ছিল সবার কাছে স্পষ্ট। একদিকে যেমন তিনি দেশের জাতির পিতার মর্যাদা পেয়েছেন, অন্যদিকে ক্ষমতার প্রতি তাঁর অদম্য আকর্ষণ ছিল অনস্বীকার্য।

শেখ মুজিবের শাসনামলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কট্টর নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নির্যাতন বাংলাদেশে এক নতুন অধ্যায় রচনা করে। ফলে অনেকেই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা চালান। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিণতি ছিল তাঁর হত্যাকাণ্ড; যা প্রমাণ করে যে, ক্ষমতার লোভ কখনো শেষ হয় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের পরের ঘটনা প্রবাহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে এক ধরনের অসাংবিধানিক শাসনের সূচনা হয়। মুজিবের হত্যার পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটি ক্রমেই অস্থিরতা এবং অরাজকতায় রূপ নেয়।

এরপর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন জিয়াউর রহমান। তবে তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন এবং ধোঁয়াশা। সামরিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসে জিয়া দ্রুত একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করেন। তাঁর শাসনকাল ছিল সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা; যেখানে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। তাঁর শাসনকালে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়নও ঘটে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার ক্ষমতা ছাড়ার সুযোগ কখনোই আসেনি; বরং ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি প্রাণ হারান। এ ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, ক্ষমতা কতটা ভঙ্গুর হতে পারে- এক মুহূর্তে যিনি শাসক, পরের মুহূর্তে তিনি হয়ে পড়েন ভিকটিম।

প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার নতুন অধ্যায় শুরু হয়। কিছু সময়ের জন্য বিচারপতি আবদুস সাত্তার দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু বিএনপির মধ্যে দলাদলির চরম অবস্থায় দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে। এ অবস্থায় এক সামরিক অভ্যুত্থানে সাত্তার ক্ষমতাচ্যুত হন।

এরপর ক্ষমতায় আসেন লেফটেন্যান্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তাঁর শাসনকালও রাজনৈতিক উত্তেজনায় ভরপুর ছিল। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তাঁর পতন ঘটে। এরশাদের শাসনামল ছিল স্বৈরাচারী; যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন প্রকট ছিল। ১৯৯৬ সালে আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়েন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একইভাবে, ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা ত্যাগ করে। এরপর বাংলাদেশে বছর দুয়েক সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনা করে।

২০০৮ সালের শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এ সময় ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার হয়; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আলোচিত বিষয়।

শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং দায়িত্ব নেন অন্তর্বর্তী সরকার। এ ঘটনাবলি বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রে আন্দোলন ও পরিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি সাধারণ সত্য দেখা যায়— যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে এবং স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে অভ্যস্ত নয়। এ আচরণের পেছনে নানা কারণে বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে।

ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং ক্ষমতার প্রতি লোভ এর অন্যতম কারণ। ফলে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে; যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্রকে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।

ক্ষমতায় আসার পর মানুষের আসল পরিচয় প্রকাশ পায় এবং এ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে না ছাড়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। হয়তো বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিরা রাজনীতিতে আসে বিখ্যাত আমেরিকান রাজনীতিবিদ কিঙ্কি ফ্রাইডম্যানের রাজনীতি শব্দের ব্যাখ্যাকে বাস্তবে রূপদানের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। কিঙ্কি ফ্রাইডম্যান বলেছেন, “পলিটিক্স” শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো- পলি (একাধিক) এবং টিক্স (রক্তচোষা পরজীবী)। তাঁর এ ব্যাখ্যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো— ক্ষমতার অপব্যবহারের শাস্তি এড়ানো। ক্ষমতায় থেকে যে পরিমাণ অপকর্ম হয়, ক্ষমতা ছাড়ার পর তাদের এর শাস্তি পেতে হবে— তা রাজনৈতিক দলগুলো খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। এ ভয় এবং দায়িত্ববোধের অভাবই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দুর্নীতির সংস্কৃতি বজায় রাখে।

ক্ষমতার অপব্যবহার কেন ঘটে, এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাই যে সাধারণ জনগণও এর জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। আমাদের দেশে দিনে-দুপুরে ভোট বিক্রি হয়; যেখানে নির্বাচনের প্রার্থীরা টাকা দিয়ে ভোট কিনে থাকেন। এ অবস্থায় শাসকরা কখনোই সত্যিকার অর্থে শাসক হয় না, বরং শোষক হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক দলগুলোর ধারণা— যতদিন তাদের ক্ষমতা থাকবে, ততদিন তাদের আধিপত্য বজায় থাকবে।

এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকন, জার্মানির এঞ্জেলা মার্কেল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অমর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে শুধুমাত্র স্বৈরাচারী, দুর্নীতিবাজ এবং শোষক হিসেবে।

এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে- বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ কেমন হবে? অদূর ভবিষ্যতে কি সত্যিকারের নেতৃত্বের উদ্ভব হবে, নাকি শোষণের চক্র অব্যাহত থাকবে?

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে আমাদের শাসকদের মাঝে কিছু সাধারণ মিল লক্ষ্য করা যায়। ক্ষমতায় এলেই বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার শুরু হয়। শেখ মুজিবের শাসনামলে রক্ষীবাহিনী বিরোধী নেতাদের ওপর স্টিম রোলারের মতো অত্যাচার চালাত। প্রেসিডেন্ট জিয়াও তার মতের বিরোধীদের দমন করার ব্যবস্থা করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার বেড়ে যায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান সত্ত্বেও, ক্ষমতা কায়েম রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে।

এ ছাড়া, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গঠনমূলক সমালোচনার পথেও বাধা সৃষ্টি করা- একটি সাধারণ প্রবণতা। শেখ মুজিবের শাসন, শেখ হাসিনার বর্তমান শাসন এবং বিএনপির শাসনামলে ভিন্নমত গ্রহণের মানসিকতা দৃশ্যমান হয়নি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ ধারাবাহিকতা আমাদের সামনে প্রশ্ন রেখে যায়- আমরা কীভাবে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারব? বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রশ্ন করতেই হয়, কি বাংলাদেশের মেকি রাজনৈতিক ইতিহাসের পরিবর্তন হবে? নাকি ঘুরেফিরে একই চিত্র আমরা দেখতে পাব? যদিও এ পুনরাবৃত্তি আমাদের কাম্য নয়।

এখন সময় এসেছে, আমাদের সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে বের হয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের। একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সক্রিয় হতে হবে। পরিবর্তন সম্ভব- এর জন্য প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ। আসুন, আমরা একত্রিত হয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে এগিয়ে যাই; যেখানে সুশাসন ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হবে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের একটাই কামনা— এমন একটি নেতৃত্ব আসুক, যারা গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণে সক্ষম, বিরোধী দলের প্রতি সহনশীল এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে অবিশ্বাসী। আমরা চাই, তারা নিজেদের জনগণের বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে যেন প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে দূরে থাকে। সর্বস্তরের জনগণের কল্যাণে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর এমন নেতা ও রাজনৈতিক দল আমাদের প্রয়োজন। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। এ প্রচেষ্টা সফল করতে হলে, আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।

আসুন, আমরা নতুন বাংলাদেশের জন্য একসঙ্গে এগিয়ে যাই।

শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ