ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দাম বাড়ে ইলিশের তবুও কষ্ট জেলেদের

প্রকাশনার সময়: ০১ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৩৩

মনমাতানো চকচকে রুপালি রঙের সুস্বাদু ইলিশ মাছ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বাঙালির প্রিয় ইলিশ যেমন সব বয়সি মানুষের কাছে প্রিয়, তেমনি এ মাছটি সুস্বাদু হিসেবে প্রায় সব দেশের মানুষের কাছে পরিচিত। রসনাবিলাসীদের কাছে ইলিশের কোনো জুড়ি নেই। বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বা অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানেও ইলিশের কদর ব্যাপক। বাঙালির প্রিয় ইলিশ নিয়ে আলোচনার যেন থামছেই না। ভারতে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের পর থেকে অনলাইন জগতে ইলিশ নিয়ে বহুমুখী আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, দেশের বাজারে ইলিশের দাম বেশি, কিন্তু ভারতে কম। কেউ বলছেন, ইলিশ উৎপাদনে কোনো খরচ নেই, তবু দাম কেন বেশি? কারো কারো মতে, ইলিশে আছে সিন্ডিকেট। আবার কেউ মনে করেন, জেলেদের আয় হচ্ছে বেশি। এসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক একটু।

বাংলাদেশের যেসব নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যে মেঘনা অন্যতম। এ নদী থেকে জেলেরা ইলিশ ধরে প্রথমে যে স্থানে বিক্রি করেন, সেটাকে বলা হয় ঘাট। মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর সীমানায় বাত্তিরখাল ঘাট অন্যতম।

শনিবার বিকাল ৪টা। মেঘনায় তখন ভাটা চলছে। ঘাটের পাশে অনেক নৌকা এসে ভিড় করেছে। জেলেরা নৌকা থেকে মাছ নামিয়ে ঘাটে বিক্রি করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে সরগরম ঘাট। জেলেরা জোয়ারের সময় জাল ফেলে ভাটায় মাছ নিয়ে ঘাটে ফিরে এসেছেন। ঘাটে রয়েছে চার কোনাকৃতির ২৭টি বাক্স।

হাসেম নামক এক জেলে এক ঝুড়ি ইলিশ নিয়ে এসে মহাজন আলাউদ্দিনের বাক্সে ফেললেন। প্রতি হালিতে (চারটি) ইলিশের ওজন হবে ২ কেজির কাছাকাছি। নিলাম শুরু হলো ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে। পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে দাম উঠল ২ হাজার ১৬০ টাকায়। বাক্সের নিলামে তিন হালি মাছ ৬ হাজার ৪৮০ টাকায় কিনে নিলেন পাইকার সোহাগ। কিন্তু জেলে হাসেম পেলেন ৫ হাজার ৮৩০ টাকা। মাছ বিক্রির কমিশন হিসেবে মহাজন আলাউদ্দিন রেখে দিলেন ৬৫০ টাকা। কেজির হিসাবে মাছগুলোর প্রতিটির ওজন গড়ে ৫০০ গ্রাম হবে। পাইকার সোহাগ ও জেলে হাসেম বললেন, ওজনের হিসাবে ঘাটে প্রতি কেজি ইলিশের দাম পড়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা। জেলে গিয়াস ৪ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি হালি বিক্রি করলেন ৮ হাজার টাকা দরে। প্রতি কেজির দাম পড়েছে ২ হাজার টাকা। জেলেরা প্রতি হালিতে পেলেন ৭ হাজার ২০০ টাকা, মহাজন পেলেন ৮০০ টাকা।

আরেক জেলে ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি করলেন হালি ৩৮০ টাকায়। অন্য একটি বাক্সে একই সাইজের মাছের হালি বিক্রি হলো ৪১০ টাকায়। প্রায় এক ঘণ্টা বেচাকেনার পর বিকেল ৫টার দিকে ঘাটের কেনাবেচা বন্ধ হয়। এ সময় মাকসুদ নামের এক জেলে এক ঝুড়ি ইলিশ নিয়ে এসে বাক্সে মাছ নিলাম করলেন। ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের প্রতি হালির দাম ওঠে ৬৮০ টাকা। অথচ মাত্র এক ঘণ্টা আগে একই সাইজের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪১০ টাকায়। জেলে সোহেল ৩০০ গ্রাম ওজনের প্রতি হালি ইলিশ বিক্রি করলেন ৭২০ টাকায়। এ সময় জেলে সবুজ ঘাটে এসে মাছের দাম দেখছিলেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, তার নৌকা এসেছে হাতিয়া থেকে। বিকালে দাম কম হওয়ায় তিনি ইলিশ বিক্রি করেননি। সবুজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাদের

নৌকায় গিয়ে দেখা যায়, ১০ জন জেলে। কথা উঠলো ইলিশ নিয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবুজ বললেন, ১০ দিন আগে ৪০ হাজার টাকার তেল ও ১৫ হাজার টাকার বাজার নিয়ে হাতিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেন তারা। মাঝে পাঁচ দিন আগে ৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করে গেছেন।

ইলিশ থেকে গত ১০ দিনে তাদের জনপ্রতি আয় কত হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে সবুজ বলেন, ১০ দিনের যাত্রায় তারা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার ইলিশ বিক্রি করতে পারবেন। এখান থেকে দশ জন জেলের খরচ বাদ দিয়ে ৯৫ হাজার টাকা সমান দুই ভাগে ভাগ হবে। একটি ভাগের ৪২ হাজার ৫০০ টাকা নৌকার মালিক পাবেন। বাকি টাকা ১৩ ভাগ হবে। এর মধ্যে নৌকার মাঝি (চালক) পাবেন দুই ভাগ, একভাগ অধিক পরিশ্রমী জেলের জন্য বোনাস আর একভাগ মালিকের। অন্য জেলেরা প্রত্যেকে পাবেন ৩ হাজার ২৬৯ টাকা। দিনের হিসাবে ১০ দিনে তাদের দৈনিক আয় ৩২৬ টাকা।

সবুজের এক সঙ্গী জেলে মাকছুদ বলেন, ‘ইলিশের দাম বেশি হলেও আমাদের তেমন আয় নেই।’ তারা বলেন, নদী ও সাগরে ইলিশ কমে গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, বেড়েছে জাল ও মাছ ধরার সামগ্রীর দামও। এ কারণেই ইলিশের দাম কমছে না। বেশি দামে ইলিশ বিক্রি করেও জেলেদের আয় হচ্ছে না।

ঘাটের পাইকার সোহাগ বলেন, ‘তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে কম দামে ইলিশ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’

সোহাগসহ আরো কয়েকজন পাইকার জানান, ঘাটে জেলেদের থেকে প্রথমে তারা ইলিশ কেনেন। এরপর তারা চাঁদপুরের বাজারে ইলিশ বিক্রি করেন। সেখান থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। তৃতীয়বার ঢাকার বড় মোকাম থেকে ছোট বিক্রেতারা ইলিশ কিনে নেন। চতুর্থবার ছোট বিক্রেতারা বিভিন্ন বাজার ও পাড়া-মহল্লায় নিয়ে ইলিশ বিক্রি করেন। এলাকাভেদে এক একটি ইলিশ কমপক্ষে তিন-চারবার হাতবদল হয়।

তারা বলেন, প্রতিটি হাতে অন্তত ১০ শতাংশ হলেও লাভ করা হয়। ঘাটের পর ক্রেতার হাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রতি ১ হাজার টাকার ইলিশে ২০০ টাকার বেশি দাম বাড়ে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট লাগে না। স্বাভাবিক ব্যবসাতেই শতকরা ১০ টাকা লাভ হয়। পাইকারদের কথায় সমর্থন জানালেন জেলে মালেক, রতন, কামাল, আড়তদার হারুন ও আড়তদার আলাউদ্দিন। তাদেরও বক্তব্য, ইলিশের দাম নির্ভর করে নদীতে ইলিশের উপস্থিতি ও খরচের ওপর। এরপর বাজারজাতকরণের খরচ ও হাতবদলে বেড়ে যায় দাম। কিন্তু ইলিশের দাম যতই বাড়ুক, জেলেদের আয় কিন্তু বাড়ে না। বরং তাদের কষ্ট বেড়েই চলছে।

নয়াশতাব্দী/জিএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ