সরবরাহের কোনো সংকট না থাকলেও বেড়ে চলেছে চালের দাম। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে কেজিপ্রতি চালের দাম ৪ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বলছে, বাজারে সরকারের নজরদারি কম থাকায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছেন। একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, জুলাইয়ের শেষ দিকে পাইকারিতে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৫৮-৬৬ টাকা। বর্তমানে তা ৬৩-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তখনকার ৫৮-৫৯ টাকা কেজির নাজিরশাইল চাল এখন ৬৪-৭৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া ৫১-৫২ টাকার মাঝারি মানের চালের দাম এখন ৫৭-৬০ টাকা কেজি। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেন, মাস দুয়েক আগেই প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৬৮-৭০ টাকা। বর্তমানে তা ৭২-৭৫ টাকায় বিক্রি করছেন। ৭৩-৭৫ টাকার নাজিরশাইল এখন বিক্রি করছেন ৮০ টাকায়। ৫৭-৫৮ টাকার বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ চাল এখন ৬২ টাকায় বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারের চাল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, সাম্প্রতিক বন্যার সময় ত্রাণ দেয়ায় মাঝারি মানের চালের দাম বাড়ে। এরপর আর কমেনি। মিলাররা চালের দাম বাড়ানোর চেষ্টায় আছেন। পরিস্থিতি বুঝে তারা দাম বাড়িয়ে দেবেন। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের কয়েকটি জেলায় ত্রাণের জন্য চাল কেনা বেড়ে যাওয়ায় মাঝারি মানের চালের চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে ওই ধরনের চালের দাম অনেকটাই বেড়েছে। সেই প্রবণতা অনুসরণ করে অন্যান্য চালের দামও বেড়েছে।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নীরদ বরণ সাহা জানান, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে তাদের পাইকারি বাজারে মাঝারি মানের চালের দাম কেজিপ্রতি ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তবে অন্যান্য চালের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। আগে মাঝারি মানের প্রতি কেজি চালের দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা। বর্তমানে তা ৫৬-৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নীরদ সাহা বলেন, দেশের কোথাও ধান-চালের সংকট নেই। আগামী আমন মৌসুমের ধান ওঠা পর্যন্ত সংকট হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমন মৌসুমের ধানের জন্য বৃষ্টির চাহিদা ছিল, সেটিও পূরণ হয়ে গেছে।
চালের দাম বাড়ার বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বাজারে সরকারের নজরদারির অভাবের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এখন মনে করছেন, বাজারে সরকারের কিছু করার নেই। এ কারণে তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়াচ্ছেন। কারণ, সরকার পরিবর্তন হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার কর্তাব্যক্তিরা অনেকে এখনো বহাল আছেন। এ কারণে ব্যবসায়ীরাও কাউকে ভয় পাচ্ছেন না।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল ১৩ লাখ ৭ হাজার ২৫৭ টন। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিদেশ থেকে আদৌ চাল আমদানি করতে হয়নি।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠার প্রায় ৩ সপ্তাহ পরও চালের বাজারে রয়ে গেছে এর রেশ। সে সময় হঠাৎ চালের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে পরিবহন ব্যবস্থার অবনতি দেখানো হলেও এবার নতুন সংকটের সুর ব্যবসায়ীদের মুখে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও পাইকারিতে ৫০ কেজি চালের বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজিতে ২ টাকা থেকে ৬ টাকা বেড়ে গিয়ে প্রভাব স্পষ্ট খুচরা বাজারে।
নগরের বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার আগের তুলনায় বর্তমানে সব ধরনের চালের দামই বাড়তি। বর্তমানে খুচরায় মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা, জিরাশাইল ৬৭ থেকে ৬৯ টাকা আর পাইজাম ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। যা আগের চেয়ে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বেশি। মোটা চাল স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা কেজি দরে। দেশে বন্যা পরিস্থিতির আগে গেল ২০ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামের বাজারে সাধারণ মানের মোটা সিদ্ধ চালের ৫০ কেজির প্রতি বস্তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার টাকা দরে। কিন্তু এখন সেই চালের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪০০ টাকায়। একইভাবে ২ হাজার ২০০ টাকার গুটি স্বর্ণা ২ হাজার ৬০০ টাকা, ২ হাজার ৫০০ টাকার নূরজাহান স্বর্ণা ২ হাজার ৮০০ এবং ৩ হাজার ২৫০ টাকার জিরাশাইল ৩ হাজার ৪৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সব ধরনের চালের দাম বস্তাপ্রতি বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত।
চট্টগ্রামের মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, বন্যার কারণেই বেড়েছে চালের দাম। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যার প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে প্রায় ৮০ শতাংশ চাল আসে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে। চট্টগ্রামে প্রায় মিলই এখন বন্ধ। এর মধ্যে কৃষকরা বেশি দাম ধরার জন্য ধান বাজারে ছাড়ছে না। কোয়ালিটি চালের দাম তাই আরেক ধাপ বেড়েছে। এর আগে, চালের বাজারে এমন লাগামহীন দামবৃদ্ধি ঠেকাতে গেল ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করে, বস্তায় ধানের জাত, মিলের ঠিকানা ও দাম লেখা বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে। এ নির্দেশনা ১৪ এপ্রিল থেকে কার্যকর করতে বলেছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু চট্টগ্রামে ৫ মাসেও সরকারের দেয়া এই নির্দেশনা কার্যকর হয়নি।
রাইস মিল মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, বাজারে চালের দাম ওঠানামা করায় বস্তার গায়ে মিল গেটে চালের দাম ও উৎপাদন তারিখ লেখা সম্ভব নয়। মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত কোথাও কার্যকর হয়নি। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ আবার কৌশল গ্রহণ করে সরাসরি বস্তায় ধানের জাত, মিলের ঠিকানা ও দাম না লিখে আলাদা করে কার্ডে লিখে দিচ্ছেন। সরকারি এ সিদ্ধান্ত মানতে গেলে সমস্যা হবে বলে জানিয়ে চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দিনাজপুর, বগুড়া নবাবগঞ্জ ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ২৫ কেজি একটি চালের বস্তা চট্টগ্রামে আসলে সেটার গায়ে দাম লেখা থাকবে ১৭০০ টাকা। দিনাজপুর, রাজশাহী থেকে এ চালের বস্তা চট্টগ্রাম আসতে খরচ পড়বে ১০০ টাকা, টেকনাফে যেতে আরো ১০০ টাকা খরচ পড়বে। তখন ১৭শ’ টাকার ২৫ কেজি চালের বস্তাটি চট্টগ্রামে দোকানদারকে বিক্রি করতে হবে ১৮শ’ টাকায় এবং টেকনাফের ব্যবসায়ীকে বিক্রি করতে হবে সাড়ে ১৮শ’ বা ১৯শ’ টাকায়। তখন ক্রেতা বস্তার গায়ে লেখা থাকা ১৭শ’ টাকার চাল ১৮শ’ বা ১৯শ’ টাকা কেন বিক্রি করা হচ্ছে তা জানতে চাইবে। এটি করার হয়তো একটি উদ্দেশ্য আছে, সেটি হচ্ছে কেউ যাতে মজুদদারি করতে না পারে।
চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রামে প্রায় ৮০ শতাংশ চাল আসে চট্টগ্রামের বাইরে দিনাজপুর, নোয়াখালী, ফেনী, বগুড়া থেকে। এসব জায়গায় এখন ধানের সরবরাহ কম। চট্টগ্রামে প্রায় মিলই এখন বন্ধ। ২০-২৫ শতাংশ মিল চালু আছে, তাও আবার ফিক্সড করা কিছু সময়ের জন্য। এর মধ্যে কৃষকরা বেশি দাম ধরার জন্য ধান বাজারে ছাড়ছে না। বিভিন্ন বন্যা বা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তো জানেন। এখন সরবরাহ নির্ভর করে ধানের ওপর। তবে এখন কিন্তু কোয়ালিটি চালের দাম আরেক ধাপ বেড়েছে, সব চাল না। সামনের দিকে দাম বাড়বে না।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, ‘দাম বাড়া বা কমার বিষয়ে যে কোনো পদক্ষেপ কেন্দ্র থেকে নেবে। আমরা মনিটরিং করছি, সেক্ষেত্রে আমাদের বিক্রেতারা ক্রয় রশিদও দেখিয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির জন্য দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে প্রতি কেজিতে বাড়েনি। যেহেতু চট্টগ্রামে চাল উৎপাদন হয় না, সরাসরি উত্তরবঙ্গ থেকে আনা হয়, তাই দাম বৃদ্ধিতে পরিবহন ব্যবস্থারও কিছুটা দায় রয়েছে।’
পরিবহন ব্যবস্থার দায় বাদ দিলে, চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়াকে কারণ হিসেবে দেখানো যাবে না বলছেন চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান। তিনি বলেন, ‘ধানের সংকট হওয়ার কথা নয়। বিশেষ করে চট্টগ্রামে যেসব ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে (ধানের) সেসবের জন্য অতিরিক্ত বীজতলা কৃষকরাই তৈরি করে রেখেছিল। আমাদের যথেষ্ট পরিমাণ ধান মজুদ থাকার কথা।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ