ঢাকা, শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শ্রীলঙ্কার একক আধিপত্যের অবসান ও অনূঢ়া কুমারার বিজয়

প্রকাশনার সময়: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯

শ্রীলঙ্কার প্রথম বামপন্থি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর শপথ নিয়েছেন অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। শপথ নিয়ে রাজনীতিকদের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার করেছেন তিনি। দেশে গণতন্ত্র সুরক্ষা ও সংহত করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। অনূঢ়া বলেছেন, ‘আমাদের রাজনীতি হতে হবে স্বচ্ছ। মানুষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন চায়। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চাই।’ ঋণে জর্জরিত দ্বীপ রাষ্ট্রটির নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য কাজটি যদিও সহজ হবে না। সরকার পরিচালনায় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তাঁকে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে টেনে তুলতে হলে অনূঢ়া অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। ১৯৬৮ সালে জন্ম নেয়া অনূঢ়া দিশানায়েকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাম রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে অনুরাধাপুরা জেলার থাম্বুতেগামা গ্রামে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছেন তিনি; বাবা দিনমজুর, মা গৃহিণী। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই দিশানায়েকে কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হন। শ্রীলঙ্কার শোষিত, বঞ্চিত সাধারণ মানুষের আস্থার নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

দিশানায়েকে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই প্রেসিডেন্ট হলেন। তাঁর দল ও জোট আগে কখনো শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল হিসেবেও ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল না। ২২৫ জন সদস্যের আইনসভায় নবগঠিত এ জোটের আসন ছিল মাত্র তিনটি। প্রভাবশালী পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বামপন্থিদের উত্থান সত্যিই অভাবনীয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফায় দিশানায়েকে ৫০ শতাংশ ভোট না পেলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পেছনে ফেলে অনেক এগিয়ে থাকেন।

শ্রীলঙ্কার নির্বাচন ব্যবস্থায় একটি ব্যালট পেপারে ভোটারদের জন্য তাদের পছন্দ অনুসারে পর্যায়ক্রমে তিন জন প্রার্থীকে ভোট দেয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে যদি কোনো প্রার্থী প্রথম গণনায় ৫০ শতাংশ ভোট না পান, তাহলে দ্বিতীয় দফায় ভোট গণনা করা হয়। সেক্ষেত্রে দুই শীর্ষ প্রার্থীকে বিবেচনায় নিয়ে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়। তাতেও বাকিদের অনেকটাই পেছনে ফেলে তিনি ৪৩ শতাংশ ভোট পান। জেভিপির ঘুরে দাঁড়ানোর কাজ সহজ ছিল না। দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে এই দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে দুইবার বিদ্রোহ করেছিল। তার পরিণতিতে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জীবন দিতে বা কারাবন্দি হতে হয়েছিল। দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরাসহ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দল সহিংসতার পথ পরিত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের কৌশল গ্রহণ করে। সেই পথেই তাঁর জয় হলো। শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন ধরে দ্বি-দলীয় ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি চলমান। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই দেশটি রাজনীতিতে বেশিরভাগ সময় শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি নিজ নিজ দল ও জোটের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ দুই দলের প্রভাব ও অবস্থান ক্ষয় হতে থাকে। তার প্রমাণ পাওয়া গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০২২ সালে এপ্রিল-জুলাই মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পণ্য সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এক নজিরবিহীন বিদ্রোহ ও জনবিক্ষোভে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যান। সেই সময় রনিল বিক্রমাসিংহে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই অভ্যুত্থানকারী নেতাকর্মীকে ধরপাকড় ও জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন।

সেই সময় ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ (জেভিপি) দলের প্রধান অনূঢ়া ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে সামনে চলে আসেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর অন্যায় নিপীড়নের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেন। ২০২২-এর জুলাই অভ্যুত্থানে অনূঢ়া ও তাঁর দল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গণ বিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জেভিপি বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান নাগরিকদের আকৃষ্ট করতে থাকে। দলের জনবান্ধব কর্মসূচির সঙ্গে বাড়তে থাকে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আবেদন ও জনপ্রিয়তা। তাঁর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ— তিনি স্বজনপ্রীতি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক, সামাজিক ভারসাম্যমূলক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বার্থের কর্মসূচি ও বক্তব্য নিয়ে হাজির হন। শ্রীলঙ্কায় বামপন্থি দিশানায়েকের বিজয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও নয়াদিল্লির জন্য খুব স্বস্তিকর নয়। কেননা, ৫৫ বছর বয়সি নবনির্বাচিত এ প্রেসিডেন্ট ভারতের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাঁর জেভিপি দলকে শ্রীলঙ্কায় চীনপন্থি হিসেবেই দেখা হয়। সেই দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেপালের পর শ্রীলঙ্কায় বামদের আগমন ঘটল। মালদ্বীপেও ড. মোহাম্মদ মুইজ্জু কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে।

গোতাবায়ার ক্ষমতাচ্যুতির পর রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে গত দুই বছরের বেশি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী, কর বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সদ্যবিদায়ী সরকার। এর চাপ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণের আশায় অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকেকে মানুষ ভোট দিয়েছেন। একদিকে আইএমএফের কঠিন শর্ত, অন্যদিকে জনজীবনের সংকট। এ সংকট মোকাবিলা করে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই হবে, আগামীতে তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছরের মার্চে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২৯০ কোটি ডলারের ঋণ পায় শ্রীলঙ্কা। এ ঋণের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন বেড়েছে, তেমনি মুদ্রার মান কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা গেছে। এদিকে ঋণ পুনর্গঠন নিয়েও নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত জুনে চীনসহ অন্য ঋণদাতা দেশগুলোর সঙ্গে এক হাজার কোটি ডলারের ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে চুক্তি করেছে কলম্বো। এ ছাড়া গত সপ্তাহে এক হাজার ২৫০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ড পুনর্গঠন নিয়েও একটি খসড়া চুক্তি হয়েছে। আইএমএফের দেয়া শর্ত পূরণ করতে হলে ঋণ পুনর্গঠন করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৈদেশিক ঋণের যে বিশাল বোঝা, তা কমানোর দায়িত্ব থাকবে নতুন প্রেসিডেন্টের। ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোকে আরো লাভজনক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, অনূঢ়া কুমারা। শিক্ষা খাতে নতুন করে ২০ হাজার চাকরির ব্যবস্থা করবেন। পাশাপাশি পর্যটনের মতো দেশটির অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোতে আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন।

একই সঙ্গে জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন সরকারি সেবার আওতা ও পরিমাণ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। অর্থায়নে ভুল পদক্ষেপ, লোকসানে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের সংকটের কারণে অনূঢ়া কুমারা শিগগিরই এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে মনে করেন না অনেক অর্থনীতিবিদ। শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে ভূরাজনীতি। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চাপে থাকতে হবে তাঁকে। কারণ, শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দেয়া দেশ দু’টি হলো ভারত ও চীন। এ ছাড়া ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটির ওপর দুই দেশই প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তাই প্রতিবেশী এ দুই দেশের সঙ্গেই ভারসাম্যের নীতিতে চলতে হবে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্টকে। শ্রীলঙ্কার যে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলারের ঋণ পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা চলছে, তার বেশির ভাগই জাপান, ভারত ও চীনের দেয়া। অনূঢ়া কুমারা অবশ্য জানিয়েছেন, এসব দেশের সঙ্গে সু-সম্পর্ক অব্যাহত রেখে প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক মিত্রতার সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চান তিনি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে ছিলেন তুলনামূলক অপরিচিত। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন— সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের পুত্র নমাল রাজাপাকসে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সজিথ প্রেমাদাসা এবং দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট জে আর জয়াবর্ধনের ভাগনে ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাঁর তুলনায় রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ছিলেন অনেক বেশি প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত। তাদের পরাজিত করে অনূঢ়া কুমারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের অবসান ঘটল।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ