ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

রাজনীতিতে আসছে চমক

প্রকাশনার সময়: ০২ অক্টোবর ২০২১, ০৫:৪৯

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো দুই বছর। ভোট হতে পারে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এরই মধ্যে অনেকটা নীরবে শুরু হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি। মাঝে মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটা দাবি তোলা হয়েছিল সরকারবিরোধীদের পক্ষ থেকে। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সামনে ধোপে টেকেনি ওই দাবি। ব্যাপারটি জ্বলেই নিভে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। এখন টেলিভিশন টকশোতে বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা অংশ নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তারা কথা বলা শুরু করেছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে। কেউ কেউ জোটের বিষয়ও তুলে আনছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে আছেন তারাও এখন নড়েচড়ে বসছেন। হিসাব কষছেন আগামী নির্বাচনে বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল নিয়ে। রাজনৈতিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়েও হিসাব করছেন তারা। এরই মধ্যে জোট নিয়ে দুই বড় দলের নির্বাচিত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। নীরব দায়িত্ব পেয়ে ওই সব নেতা আপাতত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ছক কষছেন তারা। বসে নেই বড় দুই দলের জোটের বাইরের বিরোধীদলগুলোও। আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে ‘নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার’ গঠনের রূপরেখা জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য কাজ করছেন তারা। আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা না করলেও তারা সভা-সমাবেশ ও টেলিফোনে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। শিগগিরই রাজনীতিতে নতুন চমক আসতে পারে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের আগেই রাজনীতিতে অনেক কিছু ওলটপালট হতে পারে। এছাড়া আগামী সংসদ নির্বাচনেও থাকতে পারে নানামুখী চমক। জোটগুলোতে হয়তো বড় ধরনের একটা রদবদল দেখা যেতে পারে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেও বাজছে অনৈক্যের সুর। শরিকদলগুলো নেতাদের গুরুত্ব না দেয়ায় চলছে সম্পর্ক টানাপড়েন। সঙ্গে বেড়েছে জোটে অস্থিরতারও। বাম দলগুলো নেতাদের নিয়ে বাহাস করায় ইতোমধ্যে জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা। অপরদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিএনপি। জোট থেকে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল বেরিয়ে গেছে। ২০ দলীয় জোটের সবচেয়ে বড় চমক থাকতে পারে বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছিন্নতা। সামনে এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা আসতে পারে। সঙ্গে সরকারবিরোধীদের সঙ্গে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ হতে পারে মনে করছেন তারা।

জানা গেছে, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ নির্বাচনী ‘আওয়াজ’ তোলার পরই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আগামী জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠন করার দাবিতে আন্দোলনসহ রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন করতে শুরু করেছেন। যুগপৎ আন্দোলন নাকি একমঞ্চে বসে ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায়ের জন্য লড়বেন তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

সরকারবিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ জানান, আগামী সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ করার জন্য অবশ্যই ‘নির্বাচনীকালীন জাতীয় সরকার’ অথবা ‘তদারকি সরকার’ গঠনের জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন। তবে ওই জাতীয় সরকার রূপরেখা কী হবে তা নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলতে রাজি হননি। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে বিরোধীদের তৎপরতা ঘিরে অনেকটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতারা বলেন, রাজনৈতিক পট খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। নির্বাচনের দুই বছরেরও বেশি সময় বাকি রয়েছে। তাই জোট নিয়ে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের সময় এখনো আসেনি। বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, রাজনৈতিকভাবে দুই দলই এখনো একাট্টা। বিএনপি যদি জামায়াতকে তাদের জোট থেকে সরিয়ে দেয় তাহলে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। আগে বিএনপি জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিক তারপর আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে।

২০ দলীয় জোটের শরিকের অনেকে এরইমধ্যে বিএনপিকে জামায়াত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি)’র একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বড় চমক হতে পারে ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়া। এই দলটি এ পর্যন্ত কোনো সফল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। উল্টো জামায়াতের কারণে বিএনপির রাজনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শরিকদের অনেকেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। এখন সময়ই বলে দেবে ওই পরামর্শের ভবিষ্যৎ কী হবে। তবে আগামী নির্বাচনে সব দলকে রাজনৈতিকভাবে কঠিন হিসাব-নিকাশের মধ্যে ফেলে দেবে। নির্বাচনের দুই বছরের বেশি সময় থাকলেও বর্তমান সরকারকে হটাতে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে রাজি বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের সামনে একটাই লক্ষ্যÑ স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। এই সরকারের পতন না ঘটিয়ে এদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তাই এই সরকারকে হটানো ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইস্যুতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যদি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ আপাতত করা সম্ভব না হয়, যুগপৎ আন্দোলন করতে পারি। এটাই এখন সময়ের দাবি।

তিনি বলেন, এটা শুধু বিএনপির দাবি নয় যে, এই সরকারকে হটাতে হবে। এই ইস্যুতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ইস্যুতে আমার মনে হয় কোনো দলের দ্বিমত নেই।

বিভক্তি ভুলে সরকার পতনে জোট বাঁধার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিভক্তি নয়, নিজেদের মধ্যকার ঐক্য আরো সুদৃঢ় করতে হবে। আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জোট বাঁধতে হবে। জনগণকে নিয়ে আমাদের অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে। গণআন্দোলন আর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সরকারকে পরাজিত করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিএনপি নেতাদের এ ধরনের মন্তব্যের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বিএনপি ও জামায়াত দুটি দলই রাজনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থা অতিক্রম করছে। তারা প্রচ- অগোছালো। নানা মতের নানা চিন্তার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দল দুটিকে প্রবাহিত করছে। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের শক্তি আছে কিনা তা ভাবতে হবে।

তিনি আরো বলেন, জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের একটি দল। তারা জোটবদ্ধ হয়ে আছে বিএনপির সঙ্গে। এখন বিএনপি যদি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয় তাহলে জামায়াতকে ছাড়া উচিত। আমরা দেখতে চাই সামনের দিকে জামায়াত নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী হয়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এদেশে দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন করার সুযোগ দেয়া হবে না। কারণ দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। তাই দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার আদায় করতে শিগগিরই আওয়াজ তুলবে। তদারকি সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায় করতে রাজপথে গণআন্দোলন গণসংগ্রাম সৃষ্টি করতে আলোচনা চলছে। তদারকি সরকারের কাঠামো কেমন হবে তা পরিস্থিতি বলে দেবে।

এ বিষয়ে গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিক উল্লাহ বলেন, জাতীয় সরকার গঠনের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বিশেষ মহল থেকে জাতীয় সরকার গঠনের আলোচনা উঠে এসেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে সামনে হয়তো হবে।

এদিকে সম্প্রতি এক টেলিভিশন টকশোতে ১৪ দলীয় জোট নিয়ে মন্তব্য করেছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। সেখানে তিনি জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেন, এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক যে অবস্থান তাতে মনে হচ্ছে বিপদ এখনো কাটেনি।

আমরা এই সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিপক্ষে তবে আদর্শিকভাবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছে তার পক্ষে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। এ অবস্থার পরিবর্তন হলে সময় অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধারক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় পরবর্তীতে দেশীয় জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ও মেরুকরণ তৈরি করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগির প্রশ্নে জোটের শরিকদের ভেতর মন কষাকষির জন্ম হয়। জোটের শরিকদের ভেতর থেকে একমাত্র জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ছাড়া কেউ মন্ত্রিত্ব পাননি। ফলে শরিক দলের বাকি নেতারা ছিলেন উপেক্ষিত। সেই থেকে জোটের ভেতরে শুরু হয় গৃহদাহ। শরিকদলের অনেক নেতা এখন জোটে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষে এখন বাড়ছে হতাশা ক্ষোভ-বিক্ষোভ।

তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দিলে বিরোধী দলগুলো জোরেশোরে সরকারবিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। ২০১২ সালে বিএনপি চারদলীয় জোটকে বিলুপ্ত করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোটে পরিবর্তিত হয়। এরা সবাই বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ