ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশনার সময়: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩

অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা ও অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ এবং সুষ্ঠু খাদ্য পরিকল্পনা ও সঠিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা ও মূল্য বৃদ্ধি— অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এমন এক অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিশেষ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করছে। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর দাবি জানানো হলেও তা কোনোভাবেই কার্যকর হচ্ছে না। খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং খাদ্য ঘাটতি সারা দুনিয়ার জন্য বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

খাদ্য সংকট আজ এক গুরুতর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পর্যবসিত হয়েছে। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী আশঙ্কাজনকভাবে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে। ডলারের বিপরীতে স্বর্ণের মূল্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থায় অত্যন্ত থমথমে ভাব বিরাজ করছে। চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার অস্থিতিশীল, কর্মসংস্থানের অভাবে সাধারণ ও দরিদ্র শ্রেণির মানুষের হাতে টাকাকড়ির অভাব— যেন এক নীরব দুর্ভিক্ষেরই প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার জন্য বিদেশি শক্তিও আমাদের পেছনে উঠে-পড়ে লেগেছে। স্থানীয় উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনার ওপর দেশের অর্থনীতির সাফল্য নির্ভরশীল। স্থানীয় বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ভোক্তারা মূল্যস্ফীতির শিকার হচ্ছেন। উদ্যোক্তারাও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। যে কারণে বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে বেসরকারি খাত এবং সরকারি সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় একান্ত আবশ্যক। খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্য অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি তেমন দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোথাও পণ্যমূল্যের সমন্বয় নেই। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের টানাপোড়েন চরমে পৌঁছেছে। তাদের আয় বাড়েনি, ব্যয় বেড়ে গেছে বহুগুণ। তারা যে ব্যয়ের খাত বাড়িয়েছে- তা নয়, স্বাভাবিক অবস্থায় যে ব্যয়ে জীবনযাপন করত, সেই ব্যয় দিয়ে পণ্য কিনতে পারছে না। খাদ্য, চিকিৎসা, সন্তানের লেখাপড়ার অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় ছাড়া অন্যান্য যে ব্যয়, তা অনেকে বাদ দিয়েছে। ভ্রমণ, বিনোদন, বিয়ে-শাদির দাওয়াত ইত্যাদি বর্জনের পাশাপাশি মোবাইল ডাটাসহ কম প্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়েও জীবনযাপনের টানাপোড়েনে কমাতে পারছে না। বিভিন্ন তথ্য-পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাধারণ মানুষ ভোগের চাহিদা কমাতে বাধ্য হওয়ায় পুষ্টিহীনতাসহ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য ২-৩ টেবিল চামচ তেল, ২৭০ থেকে ৪৫০ গ্রাম চাল, আটা, ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম মিশ্র শাকসবজি, ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম মাছ, গোশত, ডিম খেতে হয়। বাংলাদেশে নিম্ন আয়ের মানুষ এ খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে না। বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষ এখন দুই ধরনের পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে। প্রথমত, অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা; দ্বিতীয়ত, খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগজনিত পুষ্টিহীনতা। এর ফলে জন্ম নিচ্ছে খর্বাকৃতির ও কমবুদ্ধি সম্পন্ন শিশু। দুর্বল হয়ে পড়ছে কর্মক্ষম মানুষ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার পতিত শেখ হাসিনার ধ্বংস করে যাওয়া অর্থনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্র সংস্কারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যাংক ও আর্থিক খাতসমূহে সুশাসন ফিরিয়ে আনার সংস্কারের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। তবে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস চলছে, সেখানে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

এখন দেশের সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি এদেশের সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? সাধারণ মানুষের মধ্যে এ প্রশ্ন জেগেছে, সব কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও দ্রব্যমূল্য কেন কমছে না? সমস্যা কোথায়? স্বৈরাচারী সরকারের সময় চাল, ডাল, শাকসবজি, পেঁয়াজ, রসুন, মাছ, গোশত, ডিম, ব্রয়লার মুরগিসহ অন্যান্য পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে স্বৈরাচারের নেতাকর্মী ও পুলিশ ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি করত। এখন তা থেকে মুক্ত। তাহলে নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ছে কেন? অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে কিছু কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। ডিজেল, পেট্রলসহ জ্বালানি তেলের দাম কমিয়েছে। অথচ এর প্রভাব বাজারে পড়ছে না। নিত্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখীই রয়ে গেছে। আজ এক দামে কিনলে পরদিন গিয়ে দেখা যায় দাম আরো বেড়ে গেছে। এতে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত হতাশার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছে। চালের দাম বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত চাল রয়েছে। তারপরও চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়া অস্বাভাবিক। এখানে মিলারদের কারসাজি রয়েছে কি-না, তা সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে। তাদের মধ্যে কারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত, তা তারা ভালো করেই জানেন। এদের নিবৃত্ত করাও তাদের দায়িত্ব। তাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে, তা এগিয়ে নিতে তাদের পুরোনো মানসিকতা বদলাতে হবে। মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা নয়, বরং সৎ, মানবিকতা ও দেশের সেবার মানসিকতা নিয়ে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে।

ছাত্র-জনতা সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত— সাধারণ মানুষের নিত্যকার যেসব সমস্যা, তা নিরসনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মুটে-মজুরসহ সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ও জীবন দেয়ার অন্যতম কারণ ছিল— পতিত সরকারের কাছে তাদের জীবন-জীবিকা উপেক্ষিত থাকা। কোনো দিক দিয়েই তাদেরকে স্বস্তিতে রাখেনি। সাধারণ মানুষের চাওয়া— তারা যাতে উপার্জিত আয়ের মধ্যে থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সে সুবিধা পতিত সরকার তাদের দেয়নি। ফলে তারা শেখ হাসিনার পতন আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত— সাধারণ মানুষের কথা উপলব্ধি করে দৈনন্দিন জীবনেও তারা যে নিদারুণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা সমাধানে উদ্যোগী হওয়া। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্বস্তি দেয়ার জন্য যা করণীয়, তা করা। দেখা যাচ্ছে, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করছে সরকার। সরকার কেন তা করবে? এর কারণ ব্যাখ্যা করবে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মরিচ, শাকসবজি, মাছ, গোশতসহ নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। তাদেরকেই এর জবাব দিতে হবে এবং তা আমলে নিয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার আইনের শাসন, সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিতে প্রশাসন ও রাষ্ট্রের সব যন্ত্রের সংস্কার করবে ঠিকই, তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন সহজ ও স্বস্তিদায়ক যাতে হয়, সবার আগে সে উদ্যোগ নিতে হবে। বলা বাহুল্য, সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকলে সরকারের প্রতি তাদের সন্তোষ ও সমর্থন দুটোই থাকবে। এতে সরকারের কাজ করা সহজ হবে। সরকারকে এ বিষয়টি উপলব্ধি করে নিত্যপণ্যের মূল্য যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে স্থিতিশীল রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে।

আগেকার কোনো এক সময় গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষ খেয়ে দেয়ে সংসার চালিয়ে মোটামুটিভাবে আয়ের কিছু একটা অংশ সঞ্চয় করতে পারত। কিন্তু এখন সাধারণ মানুষ যে টাকা রোজগার করে, তা দিয়ে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করা তো দূরের কথা, তারা পূর্বে যে অর্থ সঞ্চয় করে রেখেছিল— তা তুলে তুলে খেয়ে কোনোরকম জীবন পার করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয় করার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। ব্যাংকিং ও সঞ্চয়পত্র খাত চরম আমানত সংকটে ভুগছে। যেসব সাধারণ মানুষ সঞ্চয় করেছিল, তারা জীবনযাপনের খরচ চালাতে সঞ্চয় ভেঙে এবং ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। ঢাকায় সংসার চালাতে না পেরে অনেকে পরিবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষ খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা মিটাতে না পেরে ধুঁকছে। ধার-দেনা করেও তারা সংসার চালাতে পারছে না। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এহেন পরিস্থিতিতে, পণ্যমূল্য যেমন বাড়ছে, তেমনি গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সেবার মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। সরকার টিসিবির মাধ্যমে যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করছে, তা দিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাহিদা যেমন পূরণ হচ্ছে না, তেমনি তার প্রভাব বাজারে পড়ছে না। একশ্রেণির ব্যবসায়ী বেপরোয়াভাবেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছে। এমন অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার রয়েছে, যারা আত্মসম্মানবোধ বিবেচনা না করে এখন টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পেতে আগ্রহী। তাদের কাছে এখন আত্মসম্মানের চেয়ে জীবন বাঁচিয়ে রাখা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোজা বাংলায় দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে ওষ্ঠাগত মানুষকে আজ কর্মসংস্থানের ও বাড়তি আয়ের পথ দিয়ে আশ্বস্ত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। বিদেশি দাতাদের ঋণদান পরিকল্পনা ও পদ্ধতি এবং অর্থনীতির কৌশলপত্রই আপাতত আমাদের বর্তমান ব্যর্থতার গ্লানিকে দীর্ঘায়িত করছে। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা না বদলালে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অস্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিশাল কোনো পটপরিবর্তন না হলে আমাদের আর্থিক প্রগতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হতেই থাকবে। প্রগতি কোনো কলাকৌশলের বিষয় নয়; এর জন্য প্রয়োজন যুৎসই ও টেকসই পরিকল্পনা- বাস্তবসম্মত, জনকল্যাণমূলক, কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। চলমান রাজনৈতিক দলাদলি ও প্রতিহিংসা সেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে আমাদের ক্রমশই দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

লেখক: কলামিস্ট

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ