ঢাকা, সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফুরফুরে মেজাজে জামায়াত

প্রকাশনার সময়: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৮

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় যুগ পর ফুরফুরে মেজাজে ফিরেছে জামায়াত। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ শাসনে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত দল এখন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়গুলো সচল করাসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করেছে তারা। নিষিদ্ধ প্রজ্ঞাপন বাতিল হয়েছে। এ মুহূর্তে দলটির সব মনোযোগ নির্বাচন কমিশনে (ইসি) বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পাওয়া। অন্যদিকে দল গোছাতে সারা দেশে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে দলটি। প্রায় এক যুগ ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকলেও এবার রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে চায় তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর আগের মতো মামলা, হামলা আর গ্রেপ্তারের ভয় নেই। প্রতিপক্ষ বিহীন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে সারা দেশের সংগঠন গোছাতে কাজ করছে জামায়াতের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগের আমলে দলীয় কার্যক্রম আড়ালে করতে হলেও এখন নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে জামায়াত। প্রকাশ্যে বড় আকারে চলছে সভা-সমাবেশ। রাজনীতিতে এমন অনুকূল পরিবেশ সঠিক ভাবেই কাজে লাগাতে চাইছে তারা। জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য মতে— শেখ হাসিনার পতনের ফলে যেভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছে তা গত ৫০ বছরেও ছিল না। তাই এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না শীর্ষ নেতারা। রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বড় আকারে সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করেছে জামায়াত।

সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্টে রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাপাত্তা। একদিকে ভাঙচুর, লুটপাট, হাট-বাজার, টেম্পো ও বাসস্ট্যান্ডে দখল করে অনেকটা বিতর্কের মুখে পড়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে দলের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে ৫ শতের অধিক নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছে জামায়াত। দেশের সংখ্যালঘুরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখছে দলটি। হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দিয়েছে, তাদেরকে নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেছে জামায়াত। মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করছে দলটি। ইতোমধ্যে দলটি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলটির নেতারা। ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদের পরিবারসহ সব শহীদ পরিবারের পাশে ছুটে গিয়েছেন দলের নেতারা, দিয়েছেন আর্থিক সহায়তা। আহতদের চিকিৎসার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টাও করছে দলটি। সাধ্যমতো বন্যার্তদের পাশেও দাঁড়িয়েছে। জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সারা দেশে সাধারণ সদস্য বৃদ্ধি করতে কাজ করছে জামায়াত। শুধু মুসলিমই নয়, সাধারণ সদস্য বৃদ্ধি করতে সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই কাজ করছে তারা। এ জন্য সামাজিক কাজের দিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক যেসব কর্মী ও সমর্থক রয়েছে যারা জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি তাদের সন্ধান করা হচ্ছে। নিষ্ক্রিয় কর্মী সমর্থকদেরও দলে ফেরানোর জন্য কাজ করছে জামায়াত।

এখন আর আড়ালে নয়, প্রকাশ্যেই কাজ করছে জামায়াত ও শিবির। এদিকে প্রকাশ্যে নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম। শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজ টাইমলাইনে এক স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন তিনি। এছাড়া এদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য লাউঞ্জে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান সাদিক কায়েম। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর ক্যাম্পাস রাজনীতিতে প্রকাশ্যে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্র শিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছাড়াও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত ছিলেন সাদিক কায়েম। সমন্বয়কদের তালিকায় নাম না থাকলেও তিনি সরব ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের পাশেই।

ফেসবুক পোস্টে সাদিক কায়েম লিখেছেন, ফ্যাসিস্ট শোষণ শুধু ছাত্ররাজনীতি নয়, রাজনীতির সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদে কোনো রাজনীতি থাকে না। বিরাজনীতি ফ্যাসিবাদের ভাষা। ফ্যাসিবাদ ছাড়া সব বাদ, ইজম ও রাজনীতি ফ্যাসিবাদে অনুপস্থিত থাকে। ফ্যাসিবাদে কোনো রাজনীতি নাই, শুধু ফ্যাসিবাদই আছে। টেন্ডারবাজি, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, ফাঁসি, ধর্ষণ, রাহাজানি, দুর্নীতি এসব রাজনীতি না। এগুলো ফ্যাসিবাদ। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের গত ষোল বছরের ভয়ংকর দিনগুলো কিংবা তারও পূর্বের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো রাজনীতির প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করেছিল তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। কিন্তু ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সব ভুল ভেঙে দিয়েছে। রাজনীতি সম্পর্কে তৈরি হয়েছে নতুন সচেতনতা। দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে, ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি।’

জামায়াতের একাধিক নেতা বলছেন, দীর্ঘদিন তারা রাজনীতি তো দূরের কথা, স্বাভাবিক জীবনযাপন পর্যন্ত করতে পারেননি। এখন সে অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন। প্রতিশোধমূলক রাজনীতি পরিহার করে দেশ ও মানুষের কল্যাণে সর্বত্র সংস্কার নিয়েই কাজ করতে মাঠে রয়েছেন তারা। জামায়াত তার সক্রিয় নীতি ও গতিতে এগিয়ে যাবে বলেও মনে করছেন জামায়াত নেতারা। আর আওয়ামী লীগ অন্যায়ের বিচারের ভার দেশের মানুষের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন তারা।

জানা গেছে, হামলা, মামলা আর নির্যাতনের কারণে টানা প্রায় ১৭ বছর মাঠে দাঁড়াতে পারেনি জামায়াতের নেতাকর্মীরা। দলটির ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ নেতাদের নামে ছিল মামলার পাহাড়। সরকার পতনের পর জামায়াতের নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে মামলা থেকে খালাস ও জামিন পেতে শুরু করেছেন। এছাড়া বাধাহীনভাবেও কর্মসূচি পালন করছেন তারা। খোলা হয়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের বন্ধ সব অফিস। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ৪ দিন আগে দলটির কার্যক্রম পরিচালনায় নির্বাহী আদেশে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়, তাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি পদক্ষেপ নিতে কার্যক্রম শুরু করেছে দলটি। রাজনৈতিক কার্যক্রমের চেয়ে বড় আকারে সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করেছে তারা। জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, গত সাড়ে পনেরো বছরে তাদের দলকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু যারা এ চেষ্টা চালিয়েছে তারাই শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। গত শনিবার সিরাজগঞ্জ শহরের কাজিপুর মোড়ে দারুল ইসলাম একাডেমি প্রাঙ্গণে জেলা জামায়াতের রুকন সদস্য সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। শফিকুর রহমান বলেন, আইন সবার জন্য। স্বাধীন দেশের আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। গত সাড়ে পনেরো বছরের সব বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার চাই। কিন্তু প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসার মাধ্যমে নয়। এমনকি, আয়নাঘর বা ক্রসফয়ারের মাধ্যমে নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে আমরা প্রতিটি হত্যার বিচার চাই। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি অযৌক্তিক কাজের সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু যে কোনো সমালোচনা করার আগে অন্যের কথা শোনার বা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের সহকারী প্রচার ও মিডিয়ার সম্পাদক আশরাফুল আলম ইমন বলেন, আমাদের লক্ষ্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে যে সময় লাগবে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সে সময় দেয়ার কথা বলেছে জামায়াত। তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের নানা ধরনের নির্যাতনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশের মানুষ মুক্তি পেয়েছেন। এখন পবিবর্তিত সময়ে আমরা জামায়াত স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। জামায়াতের যে নীতি রয়েছে তার ওপরই সামনে এগিয়ে যাবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ