ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মরা নদীর কান্না

প্রকাশনার সময়: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:০৯ | আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:১৪

জলে ভাসা পদ্মের মতোই সাগর মোহনায় অসংখ্য ছোটছোট ভূখণ্ডের সমষ্টিই হচ্ছে বাংলাদেশ। পাখির দৃষ্টিতে দেখলে যত না ভূমি, তার চেয়ে বেশি জলাশয়। কিন্তু অতিদ্রুত বদলে যাচ্ছে এই দৃশ্যপট। দখল-দূষণ এবং কথিত উন্নয়নে মরে যাচ্ছে নদী। বিলীন হচ্ছে খাল-বিল-হাওর-পুকুর। দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে মাটির ওপরের ও নিচের জলভান্ডার। দখল-দূষণে কেবল নয়, নদী মরে যাচ্ছে উন্নয়নেও। এর বুকে এখন আর নৌকা চড়ে না, মাঝিও গান গায় না। মরে যাওয়া শুকনো নদীতে এখন মাঝে মধ্যেই রাখাল গরুর পাল নিয়ে ঘাস খাওয়াতে নামেন। খরস্রোতা হারিয়ে যৌবনহীনা এসব নদীর কান্নাই যেন এখন নিত্যসঙ্গী। তবুও এসব দেখার যেন কেউ নেই।

সরকারি হিসাবে বাংলাদেশে নদ-নদীর সঠিক সংখ্যার তথ্য নেই। নদী নিয়ে গবেষণা করে এমন সংস্থার তথ্যমতে, এক সময় বাংলাদেশে নদ-নদীর (উপনদী-শাখা নদীসহ) সংখ্যা ছিল এক হাজারের ওপরে। বিশেষজ্ঞদের মতে ষাটের দশকে সাড়ে সাতশ’ নদী ছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে এ সংখ্যা কমে মাত্র ২৩০টিতে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছরে হারিয়ে গেছে ৫২০টি নদী। বর্তমানের ২৩০টির মধ্যে ৫৯টি আন্তর্জাতিক নদী। এগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আদি যুগে সহজ যোগাযোগের কারণেই নদী তীরে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে সত্তরের দশকেও নদীপথে পণ্য পরিবহন হতো বেশি। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারতের বাঁধের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ অন্যদিকে নেয়ায় এ চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ কমে গেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘সরকার নদী রক্ষায় আন্তরিক নয়। নদী রক্ষার আইন আছে; কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। অথচ নদীর দূষণ ও দখল কোনটাই থামছে না। নদী ধুঁকে ধুঁকে মরছে। যারা নদী রক্ষার দায়িত্বে তারা এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।’

স্বাধীনতার পর বিআইডাব্লিউটিএ’র এক জরিপের তথ্যমতে বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় চার দশকে ১৬ হাজার কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে গিয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাংলাদেশে গত প্রায় চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টা নদী, শাখা নদী এবং উপ-নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে। নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ায় জেলেরা এখন আর মাছ ধরতে পারছেন না। এতে তারা বাধ্য হয়ে পেশা বদল করছেন।

বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘নদীর সংখ্যা নির্ধারণের আগে নদীর সংজ্ঞা আমাদের জানতে হবে। দখল-দূষণের বাইরেও নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করতে হবে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়া, সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং পানির গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। এ জন্য দখল এবং দূষণই মূলত দায়ী। এ জন্য পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব পরিলক্ষিত হয়। আসলে নদী না বাঁচলে পরিবেশ এবং প্রতিবেশ বাঁচবে না। আর এসব না বাঁচলে মানুষও বাঁচবে না। তাই নদী রক্ষার বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্ম থেকেই নখ-দন্তহীন জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন কাজের এখতিয়ার হচ্ছে, সমস্যা চিহ্নিত করণ এবং সুপারিশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যা অনেকটা হিংস্র হায়না ঠেকাতে পাটকাঠি নিয়ে অবস্থান নেয়া অথবা চোরাকে ধর্মের কাহিনি শুনানোর মতো। কিন্তু প্রবচনই তো আছে, ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি!’ অথচ বিশাল প্রত্যাশা ও কথা বলে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩। এ আইনের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক নদীদূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে এ কমিশন গঠন করা হলো।’ আইনে এত এখতিয়ারের কথা বলা হলেও ভেতরে বিশাল শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন দিয়ে এ পর্যন্ত প্রাপ্তি, ‘ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দু’র চেয়ে বেশি কিছু নয়। কেবল তাই নয়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের উদ্দেশ্য এবং অর্পিত দায়িত্বগুলো সঠিক বাস্তবায়ন, আদৌ সম্ভব কিনা— সঙ্গত কারণেই জনমনে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

নয়াশতাব্দী/ইএইচ

ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজের মতো মানুষের তৈরি বাধার কারণে মরে যাচ্ছে নদী। অন্যদিকে মানুষ তার লোভ কিংবা মুনাফার টানে নদীর শুধু গতিপথই বদলে দিচ্ছে না, আঘাত করছে নদীগুলোর প্রাণবৈচিত্র্যেও। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, লৌহজঙ্গ কিংবা শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা এরই মধ্যে মারা গেছে।

ঝালকাঠি: জেলার ধানসিঁড়ি নদীটি বর্তমানে মরা রূপ নিয়েছে। দিনে দিনে এটি নাব্য হারানোর ফলে মিলিয়েও গেছে এককালের খরস্রোত। সেই ধারায় অতীতের ১১ মাইল দীর্ঘ ধানসিঁড়ি নদী ভরাট হতে হতে বর্তমানে এসে ৪ মাইলে ঠেকেছে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমে ক্রমে শীর্ণ হয়ে পড়ায় তা এখন খাল হিসেবেই পরিগণিত। শুরুতে ধানসিঁড়ি নদীটি সুদীর্ঘ থাকার পাশাপাশি প্রায় ৫০০ ফুট প্রশস্ত ছিল। নদীর দু’পাশ দিয়ে আরো দুটি নদী প্রবাহিত। এর একদিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা, অন্যদিকে কাউখালির জাঙ্গালিয়া নদী প্রবহমান। জেলার গাবখান নদীর মোহনায় জেগে উঠেছে বিশাল চর। এছাড়া বাসন্ডা খালটি জেলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেটি এখন প্রায় মরে গেছে। এর সঙ্গে স্বরূপকাঠি, বানারীপাড়া ও উজিরপুর উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগে এক সময়ের সংযোগ খালও শুকিয়ে গেছে। যার ফলে এ এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ও কৃষিতে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। অচিরেই বাসন্ডা-নবগ্রাম-গুঠিয়া খালটি এবং বেতরা-আটঘর-স্বরূপকাঠি খালের খনন করে আগের রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি এলাকাবাসীর।

মাদারীপুর: মাদারীপুরের প্রধান নদ-নদী পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, পালরদী, কুমার, নিম্নকুমার, টরকী ও ময়নাকাটার এখন বেহাল দশা। কোথাও নাব্য সংকট আবার কোথাও দখল আর দূষণে অস্তিত্ব ঝুঁকিতে। কুমার ও আড়িয়াল খাঁ নদের তীরেই গড়ে উঠেছে মাদারীপুর শহর। কুমার নদে বালু ফেলে দখল করে অবৈধ বাড়িঘর, দোকানপাট, করাতকল ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করছেন ৫ শতাধিক দখলদার। দখলদারের সংখ্যা বাড়ছে, প্রশাসনের নজর নেই। শিবচরের ময়নাকাটা নদী এখন অস্তিত্বহীন। ময়নাকাটার বুকজুড়ে ফসলের আবাদ। অন্যদিকে কালকিনির টরকী ও পালরদীরও একই দশা। বর্ষায় দু-তিন মাস পানি থাকলেও বাকি সময় থাকে কোথাও হাঁটুপানি কোথাও ফসলের মাঠ। আড়িয়াল খাঁয় জেগে উঠেছে নতুন নতুন চর।

সিলেট: স্রোতস্বিনী সুরমা এক সময় ছিল সিলেটের লাইফলাইন। নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাইকারি হাট, মোকাম। সেগুলো এখনো সরব। পাড়ের এ কোলাহল দেখে নীরবে কাঁদে এক সময়ের প্রমত্তা সুরমা। দখল-দূষণ আর ভরাটে সুরমা বিপন্ন। মহানগরের কাজির বাজার ও কালীঘাট এলাকায় নদীর তীরকে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করেছেন স্থানীয়রা। সারা দিনের উচ্ছিষ্ট এনে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী তীরে ফেলায় ধীরে ধীরে ভরাট হচ্ছে নদী।

কুষ্টিয়া: দখল-দূষণে কুষ্টিয়ার আট নদ-নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ নদ-নদীর বেশির ভাগই পদ্মা-গড়াইয়ের শাখা হলেও অবৈধ দখল, পলি পড়া ও দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ভরা যৌবন হারিয়ে এখন মরা খাল। অন্যদিকে প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অনেক স্থানেই প্রভাবশালীরা নদ-নদীর বুকে পিলার দিয়ে নানারকম পাকা স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

নাটোর : দখল-দূষণ, ভরাটের কারণে অস্তিত্ব হারিয়ে নাটোরের নারদ, বারনই, নন্দকুঁজা, আত্রাই, গুমানী, বড়ালসহ ৩২টি নদ-নদী মৃতপ্রায়। নদ-নদী এলাকার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। পানির অভাবে মিলছে না মাছ। কৃষি কাজে বেড়েছে খরচ। হারিয়ে যেতে বসেছে জেলার বড়াল, মুছা, নারদ, নন্দকুঁজা, আত্রাইসহ ছোট বড় অধিকাংশ নদ-নদী।

লালমনিরহাট: দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী তিস্তাকে উত্তরের জীবনরেখা বলা হয়। এ তিস্তায় এখন দখলের মহোৎসব চলছে। কালীগঞ্জে সোলার পাওয়ার তৈরির নামে নদীর জমি দখল করেছে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার নামে একটি কোম্পানি। অপরিকল্পিতভাবে নদীর বুক চিরে ২ কিলোমিটার লম্বা ও ৫০ ফুট চওড়া রাস্তা নির্মাণে তিস্তার বাঁ তীরের চ্যানেলটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

খুলনা: খুলনায় চলছে নদী দখলের উৎসব। প্রভাবশালীরা মহানগরীর রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাই ভৈরব, ময়ূর, ডুমুরিয়ার ভদ্রা, হরি, সুখ ও হামকুড়া নদ-নদীর জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা ইটভাটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর, হাঁস-মুরগির খামার তৈরি করেছেন।

রাজশাহী: রাজশাহীতে পদ্মা নদী দখল রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৯১ অবৈধ দখরদার চিহ্নিত করলেও নানা কারণে তাদের উচ্ছেদ করতে পারছে না। এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন মরতে বসেছে। দখল-দূষণে বিবর্ণ পুরো তীর। অনেক স্থানে বাঁধের জায়গা দখল করে নির্মাণ হচ্ছে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়।

রংপুর: রংপুর সিটি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদী ঘাঘট, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী, বুড়াইল, খোকসা ও আলাইকুমারীর প্রবাহ অবৈধ দখল-দূষণে স্বাভাবিক নেই। দখল-দূষণে এসব নদ-নদী মরে যেতে বসেছে। এক সময় এসব নদ-নদী খরস্রোতা থাকলেও এখন অতীত।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: পাড় দখল ও দূষণে বিপন্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী। মহানন্দার খালঘাট, গোয়ালবাড়ী থেকে মহানন্দা ব্রিজ পর্যন্ত নদীর পাড়ে বালু ভরাট করে বিক্রি করা হচ্ছে প্লট হিসেবে। মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদীতে ১৪৭ অবৈধ দখলদার চিহ্নিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

নওগাঁ: উত্তরের বৃহত্তর জেলা নওগাঁয় রয়েছে ছয়টি নদ-নদী— আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, শিব, পুনর্ভবা ও নাগর। জেলার অন্যতম নদী ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গায় এক সময় সারা বছর পানি থাকত। আত্রাই ও পুনর্ভবা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রতি বছর পলি জমায় ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অধিকাংশ এলাকা ভরাট হয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ড্রেজিং না করায় দুই পাড়ের জমি কৃষকসহ প্রভাবশালীরা দখল করেছে। একই অবস্থা অন্যসব নদ-নদীরও।

মেহেরপুর: দূষণ আর পলি পড়ে মেহেরপুরের নদ-নদীগুলো মৃতপ্রায়। জেলার প্রধান দুটি নদ-নদী ভৈরব ও মাথাভাঙ্গা। এদেরই শাখা নদী কাজলা, ছেউটিয়া। এর মধ্যে ভৈরব পুনঃখনন হলেও মাথাভাঙ্গা, কাজলা আর ছেউটিয়া দখলদারদের দৌরাত্ম্যে আজ মৃত।

কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা নদীটি খনন করে লেকে পরিণত করা হয়েছে। অবৈধ দখল, কচুরিপানা আর ময়লা-আবর্জনা ফেলায় ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরীসহ অনেক নদীর অস্তিত্বই বিলীন হতে চলেছে। নদীতে প্রবাহ না থাকায় কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনা জমে আবারো ভরাট হচ্ছে।

বগুড়া: করতোয়া নদীর তীরঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর গোড়াপত্তন হলেও সে সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়াও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। বগুড়া শহরের বুক চিরে প্রবাহিত করতোয়া দূষণ-দখল, ভরাট, প্রবাহ না থাকায় এখন মরা নদী।

পটুয়াখালী: পটুয়াখালী শহরের প্রাণ লোহালিয়া ও লাউকাঠি নদীর তীর দখল হয়ে যাচ্ছে। কলাপাড়ায় ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক, সোনাতলা, শিববাড়িয়া, খাপড়াভাঙ্গা, আরপাঙ্গাশিয়া ও টিয়াখালী নদী এখন ভরাট ও দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে। প্রভাবশালীরা এসব নদীর তীর দখল করে গড়ে তুলেছেন ভাটা। তোলা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা, ফেলা হচ্ছে সব ধরনের বর্জ্য। পরিবেশ সচেতন মানুষ এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

জামালপুর: নদীর উজানমুখে বাঁধ নির্মাণ আর দীর্ঘদিন খনন না করায় অবৈধ দখলে অস্তিত্ব হারাচ্ছে এক সময়ের খরস্রোতা নদী ঝিনাই। ঝিনাই নদীর বুকে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, শীর্ণ খালের মতো নদীর যেটুকু টিকে আছে তা-ও যেন অস্তিত্ব হারানোর অপেক্ষায়।

মানিকগঞ্জ: অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরি এবং উজানে পলি জমায় অভ্যন্তরীণ নদ-নদী মরে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জ শহর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া প্রমত্তা কালীগঙ্গা নদী এখন মৃতপ্রায়। দীর্ঘদিন খনন না করায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদী। নদী পরিবর্তনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে মানচিত্র। নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ভুট্টা, সরিষা কফিসহ নানা ফসল।

চুয়াডাঙ্গা: মানচিত্র থেকে একে একে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে চুয়াডাঙ্গার পাঁচ নদ-নদী। এক সময় এসব নদ-নদীর ভরা যৌবন থাকলেও এখন ইতিহাস। জেলার প্রধান নদ-নদী মাথাভাঙ্গা ও ভৈরবে এক সময় জাহাজ চলত। কলকাতার সঙ্গে এ অঞ্চলের বাণিজ্য যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নদ-নদী দুটি। অন্যদিকে কুমার নদ এবং নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীও জেলার কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে দীর্ঘ সময়। এগুলোও আজ বিলীনের পথে।

দিনাজপুর : এক সময়ের খরস্রোতা পুনর্ভবা, ছোট যমুনাসহ কয়েকটি নদী এখন পানিশূন্য ধু-ধু বালুচরই নয়, পরিণত হয়েছে খেলার কিংবা ফসলের মাঠে। জেলার ওপর দিয়ে ১৯টি নদ-নদী প্রবাহিত। এর মধ্যে ছোট-বড় আত্রাই, করতোয়া, কাঁকড়া, ঢেপা, পুনর্ভবা, গর্ভেশ্বরী, ছোট যমুনা, ইছামতী, ভেলামতী উল্লেখযোগ্য। এখন নদ-নদীগুলো হারাতে বসেছে অস্তিত্ব।

নড়াইল: নড়াইল শহরের বুক চিরে প্রবাহিত চিত্রা নদী দূষণে বিপন্নপ্রায়। নাব্য সংকটে চিত্রায় এখন নৌ চলাচল বন্ধ। মাগুরা শহরের উপকণ্ঠে বাঁধ নির্মাণের ফলে মারাত্মক ব্যাহত হয়েছে চিত্রার প্রবাহ।

পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় ৪৬ নদ-নদী। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে নদ-নদীর সংখ্যা ৩৩। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরের সব ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয় গোবরা নদীতে। নদীটি প্রায় মৃত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সোনাই নদীটি ময়লা-আবর্জনায় জীর্ণ খালে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ-ভারতের আন্তসীমান্ত নদীটি সাতবর্গ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদে পড়েছে। বাংলাদেশে নদীটির প্রবাহপথের দৈর্ঘ্য ২৪ কিমি। এখন জীর্ণশীর্ণ ও মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে।

সাতক্ষীরা: দখলের কবলে পড়ে সাতক্ষীরার বেতনা নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। প্রবাহ হারিয়ে নদীর এখন মুমূর্ষু দশা। অসংখ্য ইটভাটা ও বেড়িবাঁধ দিয়ে পুরো নদীটিই গিলে খাচ্ছেন প্রভাবশালীরা।

সিদ্ধিরগঞ্জ: প্রাচ্যের ডান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ গোড়াপত্তন হয়েছিল শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। এ নদী নিয়েই এখন গভীর উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জবাসী। দূষণে শীতলক্ষ্যার পানির রং কালো হয়ে আলকাতরার রূপ নিয়েছে।

গাজীপুর: জনশ্রুতি আছে গাজীপুরের চিলাই নদী পাড়ি দিতে গিয়ে চিল ক্লান্ত হয়ে পড়ত, যে কারণে এর নাম চিলাই। শ্রীপুর উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তে শুরু হওয়া নদীটি বিভিন্ন পথ পেরিয়ে পুবাইলে বালু নদে মিশেছে। বর্তমানে শীর্ণ এ নদীকে স্থানীয়রা চিলাই খাল হিসেবে জানেন। গাজীপুরের হূৎপিণ্ড এটি। এক সময়ের প্রমত্তা চিলাই এখন সরু খাল। ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি দখলমুক্ত ও খনন করে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

টঙ্গী: দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে তুরাগ নদের অস্তিত্ব। দখল-দূষণ আর নাব্য সংকটই এর মূল কারণ। তুরাগ তীরের ওয়াকওয়ে পর্যন্ত দখল হয়ে যাচ্ছে।

এভাবেই দেশের আরও অনেক নদীর মতো টাঙ্গাইল শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া লৌহজঙ্গ নদীটি এখন একটি ড্রেন। নদীর এ শাখার ওপরই নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল মার্কেট। ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ ও সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বেতনা, মুক্তেশ্বরী— এর মতো নদীগুলো এখন মৃত্যুর দিন গুনছে। একই চিত্র ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতী, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ির গড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দরবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদীর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের পানি প্রত্যাহারে যেমন নদী মরছে তেমনি অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন প্রকল্প করেও নদী ধ্বংস করা হচ্ছে। অচিরেই ষাট দশকে থাকা সব নদী ও খালের খরস্রোতা ফেরাতে পুনঃখননসহ এখনই কার্যকরী পদক্ষেপ জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ