সই ছয় ছাত্রের কথা মনে আছে? যাদেরকে ‘ডাকাত’ সন্দেহে ২০১১ সালের জুলাই মাসে আমিনবাজারে মেরে ফেলা হয়েছিল? বা উত্তর-পূর্ব বাড্ডার তসলিমা বেগম রেণু নামের এক মায়ের কথা? ২০১৯ সালে তাকে ছেলেধরা সন্দেহে হাজার হাজার মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল অথবা নোয়াখালীর কিশোর ভ্যানচালক সামছুদ্দিন মিলনের কথা? যাকে পুলিশের সামনেই ডাকাত সন্দেহে জনতা হত্যা করেছিল। এ তো মাত্র দূর সাম্প্রতিক তিনটি ঘটনার কথা বললাম। নিকট সাম্প্রতিক ঘটনাটি মাত্র সেদিন ঘটল (৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪) যার বলি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামের এক ব্যক্তি। মাত্র দু’দিন আগে (১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪) ঘটল আরো মর্মান্তিক দুটো ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে একজন ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন এবং মেরে ফেলার আগে তাকে ভাত খেতে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এগুলোই প্রথম নয়, এরকম অগণিত ঘটনার ইতিহাস বাংলাদেশে বহু বহু কাল ধরে চর্চিত। আজও এর ধারাবাহিকতা থামেনি বরং ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
‘ধর ধর চোর চোর মার মার’- গ্রামগঞ্জে রাতের আঁধারে বা ভরদুপুরে জনাকীর্ণ কোনো শহরে এ ধরনের আচমকিত চিৎকার-চেঁচামেচি এবং পরক্ষণে শত শত হাত বা অস্ত্রের আঘাতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে এ দেশের মানুষ কমবেশি পরিচিত। তবে এ ঘটনা সংশ্লিষ্ট মার্কিনি ‘মব’ শব্দটি ক’দিন আগেও এদেশে তেমন প্রচলিত ছিল না, যেটি আজকাল বেশ জনপ্রিয়। ‘ফ্ল্যাশ মব’, ‘মব জাস্টিস বা মব লিঞ্চিং’ শব্দগুলোর ব্যবহারও ইদানিং খুব বেড়েছে। ‘মব’ শব্দটির অর্থ মূলত এমন একটি উত্তাল ক্ষুব্ধ বা হুজুগে জনতা, যেটি সহজে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। আকস্মিকভাবে সৃষ্ট এ ক্ষুব্ধ বা হুজুগে জনতা দ্বারা যখন বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তখন তাকে ‘মব লিঞ্চিং’ বলে। আর ‘মব জাস্টিস’ বলতে এ ধরনের জনতার দ্বারা সংঘটিত মারপিট বা হত্যাকাণ্ডকে বিচার হিসেবে বোঝায়। শব্দ বা ভাষা প্রয়োগের আধুনিকতায় আমরা ‘মব জাস্টিস’ অথবা ‘মব লিঞ্চিং’ যাই বলি না কেন আদতে আমরা যুগ যুগ ধরে এ সম্পর্কিত ঘটনা দেখে অভ্যস্ত। ‘মব লিঞ্চিং’ বা ‘মব জাস্টিস’কে এদেশে গণপিটুনি অথবা গণধোলাই হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নানা কারণে গণপিটুনি শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত উপমহাদেশে বহুল সংঘটিত একটি ক্রাইম বা অপরাধ।
‘গণপিটুনি’ বা গণপিটুনির মাধ্যমে হত্যার নানাবিধ প্রেক্ষাপট, কারণ, ফলাফল পর্যালোচনা করতে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন; যেটি এ স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তবে এ উত্তেজিত জনতা সম্পর্কে বিখ্যাত সমাজ মনোবিজ্ঞানী গুস্তাভ লে বোঁ (Gustave Le Bon)) বলেছেন, ‘জনতার ভিড়ে ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার বিলুপ্তি ঘটে এবং প্রতিজন ব্যক্তি মিলে উত্তেজিত জনতার সমষ্টি তৈরি হয়। জনতার ‘সম্মিলিত মন’ তখন বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নেয়।’ অন্যদিকে মার্টিন জনতার এ আচরণকে ‘পাগলামি’ বলেছেন।
পাগলামি হোক বা উন্মত্ততা, আদতে একজন ড্রাইভার কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটালে বা কোনো চোর চুরি করলে অথবা প্রকাশ্যে কেউ কাউকে কিস করলে, ইভটিজিং করলে- এসব ঘটনায় প্রতিবাদ চলতে পারে, অবস্থার প্রেক্ষিতে মব চড়াও হতে পারে, কিন্তু এতে যদি সেই অপরাধী অথবা নিরপরাধী মারাত্মকভাবে আহত হয় বা মৃত্যুবরণ করে; তবে তা হবে ‘মব লিঞ্চিং’ যা অবশ্যই বিচারবহির্ভূত হত্যা। অথচ যখন উন্মত্ত জনতার বিচারবুদ্ধি লোপ পায়, ভালো-মন্দের বিচার করার ক্ষমতা তখন তাদের থাকে না। সুতরাং এ ধরনের মব কখনোই জাস্টিসের মাধ্যম হতে পারে না।
বাংলাদেশে মোটামুটি কয়েক বছরের গণপিটুনির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গণপিটুনিতে ৮০০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। নিছক ডাকাত, ছেলেধরা বা চোর সন্দেহে তাদের অনেককে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এরপর গত সাড়ে ছয় বছরে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে আরো প্রায় ২৮৬ জন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে নির্বাচনের পর গত সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) গণপিটুনিতে নিহত হন ৩২ জন। ঢাকাতেই নিহত হন ১৬ জন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেশ কয়েকটি ‘গণপিটুনির’ ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় উসকানির প্রতিবাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতেই হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করতে দেখা গিয়েছে। এতে উৎসব মণ্ডল নামে এক কিশোর মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
জনতা দ্বারা সংঘটিত এ ক্রাইমের মূল কারণ হিসেবে মনোবিশ্লেষকগণ সার্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় ‘বিচারহীনতাকেই’ দায়ী করেছেন। তাদের মতে, মানুষ যখন ক্রমাগত অন্যায়ে আর বিচারহীনতায় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তখনই ‘মব জাস্টিসে’র নামে ‘লিঞ্চিং মবে’র প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। বলা যায়, ‘মব জাস্টিস’ অসহিষ্ণু সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। এ প্রেক্ষিতে গত ক’দিনে ঘটে যাওয়া ‘গণপিটুনি’কে অনেকেই বিগত সরকারের অত্যধিক দুর্নীতি, বিচারহীনতা, নির্যাতন, দলীয়করণের ফল হিসেবে দেখছেন।
সামাজিক বিশ্লেষকদের কারো কারো মতে, সমাজে এখন ‘গণপিটুনির’ মাধ্যমে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেটি অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হচ্ছে। অতীতের দুর্নামের কারণে সাধারণ মানুষ পুলিশ বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আবার পুলিশ বাহিনীও এখনো পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হতে পারছে না। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এখনো সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি। ফলত একটি পক্ষ তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য নানাবিধ অপরাধ কর্মে জনতাকে ব্যবহার করতে চাইছে।
আগে বা সম্প্রতি যে কারণেই ঘটুক গণপিটুনির মাধ্যমে প্রতিটি হামলা বা হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বিচারবহির্ভূত। অনেকে এটির নাম দিয়েছেন ‘মব জাস্টিস’ বা ‘জনতার বিচার’ অর্থাৎ দেশের প্রচলিত আইন বা বিচারব্যবস্থা যে অন্যায়ের শাস্তি দিতে পারছে না, সেটি দিচ্ছে জনতার আদালত। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, শুধুমাত্র সন্দেহের কারণে বা কারো ব্যক্তিগত শত্রুতায় উসকানির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষও উল্লসিত জনতার হাতে মারা পড়ছে বা পড়তে পারে? সুতরাং এ অসুস্থ চর্চা বন্ধ করতে হবে।
যে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে তরুণ বা ছাত্রসমাজ বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে তার সুফল পেতে প্রতিটি অন্যায়ের বিচার হওয়া উচিত নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে এবং দেশের প্রচলিত আইনে। এক্ষেত্রে যেমন দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব আছে। কেউ একজন কারো বিরুদ্ধে উসকানির মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে হুজুগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারপিটে শামিল হওয়া সুস্থ মানসিকতার পরিপন্থি। বরং অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রক্ষা করে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করাই নাগরিকতার উত্তম দৃষ্টান্ত।
গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় দেশের প্রচলিত আইনে মামলার সুযোগ রয়েছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গণপিটুনির ঘটনায় মামলা হয়তো হয় কিন্তু এর প্রেক্ষিতে বিচার হওয়ার নজির কম। সে ভিকটিম অপরাধী হোক বা নিরপরাধী। ২০১১ সালে যে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়, সেই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এখনো মামলাটি আপিল আদালতে ঝুলে আছে। বাড্ডায় নিহত তসলিমা বেগম রেণুর মামলার বিচারকার্যেরও এ পাঁচ বছরে তেমন অগ্রগতি নেই। সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণই শেষ হয়নি। এভাবে প্রায় সব মামলার অবস্থা তথৈবচ। যে বিচারহীনতার দোহাই দিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করা হচ্ছে, সেই বিচারহীনতাই ‘মব লিঞ্চিং’কে উৎসাহিত করছে। বিষয়টি যেমন পীড়াদায়ক, তেমনি উদ্বেগজনক এবং দেশের সামগ্রিক বিচারব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টান্ত।
সাধারণত অস্বাভাবিকভাবে কোনো সরকারের পতনের পর নানাবিধ কারণে পরবর্তী সরকারের সামনে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। সব থেকে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। সেই হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেয়া। এ প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রকে সম্পূর্ণ সচল করতে সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীসহ প্রশাসন তথা বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা তৈরি করা।
আমরা অত্যন্ত আশাবাদী যে, খুব দ্রুতই এ সরকার ‘মব জাস্টিস’ বা ‘গণপিটুনি’ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সহকারী অধ্যাপক
ময়মনসিংহ কলেজ
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ