ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। সরকার পতনের দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখনো কার্যত স্থবির বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি)। ভয়-শঙ্কায় অধিকাংশ সদস্য অফিস করছেন না। কর্মকর্তাদের মধ্যেও চাপা ‘আতঙ্ক’। যার প্রভাব পড়ছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটির কাজ-কর্মে। তিনটি বিসিএসসহ কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। অনেকটা বাধ্য হয়ে নন-ক্যাডার ও জনপ্রশাসনের অধীনে পদোন্নতির জন্য বিভাগীয় পরীক্ষাগুলোও স্থগিত করছে প্রতিষ্ঠানটি। পিএসসিতে সৃষ্ট এমন অচলাবস্থায় বেকায়দায় পড়েছেন কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী।
সংস্থাটির এমন অবস্থায় চাকরিপ্রার্থী বেকারদের জন্য আরো বড় দুঃসংবাদ সামনে এসেছে। আসন্ন ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি যথাসময়ে প্রকাশ করা নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়। খোদ পিএসসির কর্মকর্তারাই এ নিয়ে ‘অন্ধকারে’। আবার বিজ্ঞপ্তি দেরিতে হলে বয়সের ছাড় মিলবে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। ফলে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি পিছিয়ে যাওয়াটা হবে চাকরিপ্রত্যাশীদের মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) দপ্তর সূত্র জানায়, বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা পিএসসির নিয়মিত কাজের অংশ। গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এবারো তেমন পরিকল্পনা নিয়েছিল পিএসসি। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার নভেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সম্ভাবনা খুবই কম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিএসসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো অবগত করে থাকি। সেখান থেকে এখনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যথাসময়ে চাহিদাপত্র পেলে বিজ্ঞপ্তিও ঠিক সময়ে দেয়া যাবে। আর চাহিদাপত্র পেতে দেরি হলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশও পিছিয়ে যেতে পারে। কারণ বিসিএসের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে কত পদে নিয়োগ দেয়া হবে, সেটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেয়। মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠায় পিএসসি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চাহিদাপত্রে শূন্যপদ কত বা কতসংখ্যক পদে নিয়োগ দেয়া হবে, সেটা উল্লেখ করে তা পিএসসিতে পাঠিয়ে দেয়। সেটা যাচাই করে সব ঠিক থাকলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পিএসসি যখন চাহিদাপত্র পাঠায়, তারপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে শূন্যপদ বা লোকবলের চাহিদা কত, তা চাওয়া হয়। সেগুলো মন্ত্রণালয়ে এলে যাচাই চাহিদা পিএসসিতে পাঠানো হয়। স্বাভাবিক সময়েই এ প্রক্রিয়া সম্পন্নে বড় একটি সময় লেগে যায়। তাছাড়া ক্যাডার পদে চাহিদা নিরূপণ করা যতটা সহজ, নন-ক্যাডারে চাহিদা নিরূপণ করা ততটাই জটিল। তার ওপর এবার প্রশাসনে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা, তাতে চাহিদা নিরূপণ করে পাঠাতে দেরি হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পিএসসির এক সদস্য নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্থবিরতা থাকলে সব কাজে প্রভাব পড়বে। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তিও পিছিয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ইমারুল হক। ৪৫তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে টিকে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। তবে প্রস্তুতির অভাবে পরীক্ষা ততটা ভালো হয়নি। সবশেষ ৪৬তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই বাদ পড়েছেন তিনি। চাকরির আবেদনের বয়স একেবারে শেষ দিকে তার। জানুয়ারিতে তার বয়স ৩০ পূর্ণ হবে। ফলে ইমারুলের শেষ ভরসা ৪৭তম বিসিএস।
যথাসময়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না হলে এবং বয়সের ছাড় না পেলে বঞ্চিত হবেন জানিয়ে ইমারুল বলেন, ‘৪৫তম বিসিএসে লিখিত দিয়েছি। পরীক্ষা ভালো হয়নি। মোটামুটি নিশ্চিত যে আমি পাস করব না। মাঝে ৪৬তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে টিকতে পারিনি। এজন্য পুরোদমে ৪৭তম বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এখন যদি এটা পিছিয়ে যায়, বয়সের ছাড়ও না পাই, তাহলে আমার শেষ ভরসাও শেষ।’
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রশাসনে কর্মরতদের রদবদল চলছে। ঢেলে সাজানোর এ প্রক্রিয়ার পুরোটাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে করতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় পিএসসি নিয়ে এখনো আলোচনা বা করণীয় ঠিক করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আনন্দ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের জায়গা থেকে সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা আছে। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো অবগত করে থাকি। সেখান থেকে এখনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। যথাসময়ে চাহিদাপত্র পেলে বিজ্ঞপ্তিও ঠিক সময়ে দেয়া যাবে। আর চাহিদাপত্র পেতে দেরি হলে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশও পিছিয়ে যেতে পারে।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পিএসসির সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়গুলো দেখভাল করে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ। এ বিভাগের যুগ্ম-সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটা সরকার পরিবর্তন হয়ে যখন আরেকটা সরকার দেশে আসে, সেসময় পিএসসি এমন স্থবির থাকে কিছুটা সময়। জাতীয় নির্বাচনের সময়েও এটা ঘটে। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। এবার তো পরিস্থিতি আরো ভিন্ন। কিছুটা সময় হয়তো লাগবে।’
৪৭তম বিসিএস যথাসময়ে হওয়া নিয়ে সংশয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বৈষম্যের শিকার, বেকার তরুণ ও যুবসমাজের জন্য গুরুত্বসহকারে কাজ করছি। চাকরিপ্রত্যাশীদের আমরা হতাশ করব না। দ্রুত কাজগুলো সম্পন্ন করা হবে। যতদূর জানি পিএসসি এখনো চাহিদাপত্র পাঠায়নি। সেখান থেকে আগে পাঠানো হোক, প্রয়োজনে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিকে কাজগুলো করে দেব।’
সাড়া নেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের!
পিএসসি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। নিজস্ব আইন ও বিধির মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়। তবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও পিএসসি সবসময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে সব ধরনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। সহজে বলতে গেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পিএসসি। পিএসসির পরীক্ষা শাখার একজন পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক জানান, ৫ আগস্টের পর পিএসসি থেকে যতগুলো পত্র জনপ্রশাসনে পাঠানো হয়েছে, তার মধ্যে ৯০ শতাংশের প্রতিউত্তর মেলেনি। পিএসসির পরিস্থিতি জানিয়ে চিঠি দেয়া হলেও জনপ্রশাসন থেকে কোনো সাড়া নেই। প্রতিনিয়ত চাকরিপ্রার্থীরা পিএসসিতে এসে বিক্ষোভ করছেন, তারা দাবি-দাওয়া জানিয়েছেন যেগুলো তা জানানো হলেও করণীয় সম্পর্কে কোনো পরামর্শ ও নির্দেশনা মন্ত্রণালয় দেয়নি। তাদের ভাষ্যমতে, ‘সার্বিক দিক খেয়াল করলে দেখা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পিএসসি এখন অনেকাংশে সংযোগবিহীন। এমন হলে পিএসসি ঘিরে সংকট আরো বাড়বে।’
অন্যদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত প্রশাসনে কর্মরতদের রদবদল চলছে। ঢেলে সাজানোর এ প্রক্রিয়ার পুরোটাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে করতে হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের উচ্চস্তর থেকে একেবারে নিচের স্তরের সব কর্মকর্তা ব্যস্ত সময় পার করছেন। তাদের দম ফেলার ফুরসতটুকুও নেই। এমন অবস্থায় পিএসসি নিয়ে এখনো আলোচনা বা করণীয় ঠিক করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। এজন্য স্বাভাবিক যোগাযোগে কিছুটা ভাটা পড়েছে। দ্রুত সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে মন্ত্রণালয়।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের যুগ্ম-সচিব ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পিএসসির সঙ্গে আমরা একেবারে যোগাযোগহীন, এটা সত্য নয়। আমি নিজেও কয়েকদিনের মধ্যে একবার যোগাযোগ করেছিলাম। কথা বলেছি, কাজও হয়েছে।’
পিএসসির অনেক সদস্য অফিস করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের ব্যাপারে সরকারের মনোভাব কী- এমন প্রশ্নের জবাবে এ যুগ্মসচিব বলেন, ‘হ্যাঁ, এখন কিছু সদস্য হয়তো কাজ করছেন না। আমি যতদূর জানি, পিএসসির চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করছেন। কিছু সদস্যও আসছেন। কিছু সদস্য হয়তো আসছেন না। অনেকের বিষয়ে জানতে পারছি যে, তারা পদত্যাগ করবেন। আমরাও অপেক্ষা করছি। কেউ যদি স্বেচ্ছায় সরে যেতে চান, তাহলে তো কিছু বলার নেই। আমরা পিএসসির কাউকে সরে যেতে বলিনি।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ