ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নারীর অপমান সভ্যতার অভিশাপ

প্রকাশনার সময়: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০৩

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আমি আমার কন্যাদের নিয়ে যাওয়া এখন আর নিরাপদ বোধ করব না। ছাত্র-জনতার কাছে পুলিশ রিজেক্টেড হয়ে পড়ায় এখন মোরাল পুলিশিং-এর দায়িত্ব পালনের অভিযোগ উঠছে ছাত্রশিবিরের ছেলেদের বিরুদ্ধে। শর্ট ড্রেস পরায় জনৈক এক নারীকে সৈকতে যেভাবে জনসমক্ষে কয়েকডজন ভিডিও ক্যামেরার সামনে কান ধরে উঠবস করানো হলো, কেউ কেউ লাঠি দিয়ে পেটাতে এলো, কেউবা অশ্লীল সম্বোধন করে ‘কান ধর’ বলে মনের উদগ্র অবদমন মেটাল; তাতে ওই সৈকত ভ্রমণের রুচি মরে গেল। ওই বিচে আমি যদি আমার দুই কন্যার হাত ধরে হাঁটি, আমার স্ত্রীর হাতে হাত রাখি; নিশ্চিত অশালীন মন্তব্যের শিকার হতে হবে। কন্যাদের কাছে বিব্রত হতে হবে। ওরাও ভয় পাবে। এই যে আপনাদের দেখে আমরা ভয় পাচ্ছি— এটা দিয়ে আপনাদের আসলে কী অর্জন হবে?

নারী নিপীড়নের অভিযোগে অভিযুক্ত তরুণদের ওই দলটি এই নারীটি ছাড়াও আরো অন্তত দুই জনকে সমুদ্র সৈকতে হেনস্তা করেছে। দুঃখজনক সত্যিটা হলো কান ধরে উঠবস করানো নারীকে হেনস্তার শুরুতে অন্য এক জন হিজাব পরিহিত বয়স্ক নারীকেও সহযোগিতা করতে দেখা গেছে।

আপনাদের ভিডিওগুলো ইতোমধ্যে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের কোনো নারী আর কেন আসবে আপনাদের বিচ দেখতে? একদিকে তাদের গায়ের রং দেখে আপনারা সিডিউসড হয়ে পড়বেন। অন্যদিকে তাদের নিজস্ব ঢঙের পোশাক দেখেই আপনারা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম কান্ট্রি ইন্দোনেশিয়ার নাম শোনেননি আপনারা? ইউটিউবে দেখে নিয়ে মানুষের সঙ্গে ম্যানারিজমটা শিখে নিন। জেনে নিন আমাদের মুসলিমদের ফাদার কান্ট্রি সৌদি আরবের প্রাইম মিনিস্টার মুহাম্মদ বিন সালমানের হাজার কোটি ডলারে বানানো নিঅম সিটির সমুদ্রসৈকত কেমন হচ্ছে!

প্রথম আলো জানাচ্ছে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দুই তরুণীকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক মারধর, কানে ধরে ওঠবসসহ হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলামকে (২৩) নামের এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ।

গত শুক্রবার রাতে শহরের ভোলা বাবুর পেট্রোল পাম্পসংলগ্ন এলাকা থেকে তাকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি)। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে তরুণীদের হেনস্তার সঙ্গে জড়িত বাকিদের শনাক্তকরণের কাজ চালাচ্ছে পুলিশ। আটক মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি এলাকার বাসিন্দা মাজেদুল ইসলামের ছেলে। মাদরাসা ছাত্র ফারুকুল নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে শিবির কর্মী বলে পরিচয় দিয়েছেন।

প্রথম আলো জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সমুদ্র সৈকতের চেয়ারে বসে থাকা এক তরুণীকে চার যুবক ঘিরে ধরেন। প্রথমে ওই তরুণী পরিচয় এবং কী কাজে এত রাতে একা সৈকতে অবস্থান করছেন জানতে চান যুবকরা। জবাবে তরুণী ঘুরতে আসার কথা জানালে যুবকরা সৈকতের সামাজিক পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগ তুলে ওই তরুণীকে চলে যেতে বাধ্য করেন। আরেকটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সাধারণ পোশাকে থাকা এক ব্যক্তিকে এক তরুণী কান্নারত অবস্থায় বলছেন, ‘উনি (লাঠি হাতে যুবক) আমার ফোন কেড়ে নিয়েছেন। দয়া করে ফোনটি ফেরত দিন। প্রয়োজনে মোবাইলে থাকা সবকিছু ডিলিট করে দেব।’

এ ঘটনাটি নিয়ে দেশের শোবিজ অঙ্গনের তারকারা ছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ আলোড়ন তোলে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানের বিভিন্ন ফোরামে দেয়া বক্তব্যে হিপনোটাইজ হয়ে পড়েছিলাম। এখনো আমাদের ঘোর কাটেনি। মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন কীভাবে? এতটা উদার ও ক্ষমাশীল হওয়া যায়? জানি না এমন পরহেজগার আমির এতগুলো তরুণের দ্বারা তিন জন নারীর এমন অপমান কী চোখে দেখবেন? মানুষ ভুল করলে তার ব্যাপারে আইনে প্রতিকার চাওয়ার বহু পন্থা আছে। মব জাস্টিস মানবাধিকার রক্ষা ও সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার বড় প্রতিবন্ধকতা।

বুঝে নিয়েছি আপনারা হয়তো নারীর অসম্মানকে জাস্টিফিকেশন দিতে ধর্মকে জুজু মানছেন। কথা দিচ্ছি আপনারা ক্ষমতায় যান, সংবিধান বাতিল করেন, গণতন্ত্র তাড়িয়ে দেন; আপনাদের মোরাল পুলিশিং মেনে নিতে বাধ্য থাকব। তার আগ পর্যন্ত সর্ব মানুষের স্বাধীন চলাচলে আপনাদের উদারনৈতিক সমর্থন ও সংহতি দাবি করছি। এখনো বিশ্বাস করি, দেশে আপনারাই সবচেয়ে গোছানো ও সংঘবদ্ধ দল। হীন কাজ করে কেন খামোখা বদনাম কুড়াবেন? গণতন্ত্র মানলে সামনে আপনাদের ভোটের মাঠেও তো যেতে হবে, তাই না?

আমাদের উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম মহাকাব্য রামায়ণ। শক্তিধর মহারাজ রাবণ ধ্বংস হয়েছিলেন সীতা অপহরণের কারণে। অপরদিকে মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ দ্রৌপোদীর বস্ত্র হরণ। যা না ঘটলে হয়তো এতটা ক্রোধ বা জেদ দেখাতো না পাণ্ডবরা।

ইসলামের ইতিহাসেও আমরা দেখি নারীর অপমান মানেই পরাজয় ডেকে আনা।

নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায় ইসলামিক হিস্টোরিতে। যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ‘বনু কাইনুকা’ নামের একটি গোত্রের সঙ্গে।

আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, একদিন জনৈকা মুসলিম নারী বনুু কাইনুকা গোত্রের বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদি তার মুখের নেকাব খোলানোর অপচেষ্টা করে, তাতে ওই নারী অস্বীকৃতি জানান। ওই স্বর্ণকার গোপনে মুসলিম নারীটির (অগোচরে) পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্তে গিঁট দিয়ে দেয়, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। ফলে তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে স্বর্ণকার ও তার সতীর্থরা হো হো করে হেসে উঠে হাততালি দিতে থাকে। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন।

পরে এ ঘটনার রেশ ধরে শুরু হওয়া যুদ্ধে ওই স্বর্ণকারের বংশ ‘বনু কাইনুকা’ রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্বে থাকা মুসলিমদের হাতে শোচনীয় পরাজয় হয়।

এজন্যই আমরা বলি মায়েরা জিতলে জয়ী হয় মানুষ। নারীর অপমান মানে সভ্যতার অভিশাপ। পুরাণ কথা বা ধর্মীয় ইতিহাস এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নাই। আমরা যতটুকু করব তার ফল ভোগ করতে হবে এটাই চিরায়ত সত্য। আমরা সবাই যেন বিষয়টা খেয়াল রাখি।

লেখক: সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ