ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলামী জোট গঠনে তৎপরতা

প্রকাশনার সময়: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২১

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতির পট পরিবর্তন হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে যেসব ইসলামী দলকে দমন পীড়নের মাধ্যমে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হয়েছে, তারা এখন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন অভিন্ন উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে এসব দল। একটি বৃহত্তর জোট গঠন করে দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে পরস্পরের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে তারা। বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর মধ্যে অতীতে মতভেদ দেখা দিলেও তা ভুলে বৃহত্তর ‘ইসলামী জোট’ গঠনে চলছে জোর তৎপরতা। জোট গঠন করার লক্ষে তারা নিজেদের মধ্যে বাড়িয়েছে যোগাযোগ। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও চলছে নানামুখী আলোচনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ইসলামী দলগুলো জোট গঠনের উদ্যোগ নিলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা সফলতার মুখ দেখেনি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তারা ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছে। জোট গঠনে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফতে মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ মুসলীম লীগসহ সমমনা বেশ কয়েকটি ইসলামী দল এই জোটে যোগ দিতে পারে। জোটের চমক হতে পারে অ-রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সমর্থন। এ জোটকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ইসলামী দলগুলোর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এতে সমমনা দলগুলো জোট গঠনের ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।

ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা দলগুলোর একাধিক নেতারা জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা একটি ঐক্য গঠন করতে যাচ্ছেন। অতীতে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে আদর্শ ও মত পার্থক্য থাকলেও এসব ভুলে গিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে তারা এক মঞ্চে আসতে চাইছেন। তাদের প্রত্যাশা, গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইসলামী দলগুলো বৃহৎ জোট গঠন করলে রাজনীতিতে নতুন একটি শক্তির আবির্ভাব ঘটতে পারে। নিজেদের মধ্যে মতের ভিন্নতা থাকলেও ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার আলোকে রাষ্ট্র গঠনের অভিন্ন উদ্দেশ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ জোটে শুধু ইসলামী দল নয়, যারা ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে এমন সব দলকেই যুক্ত করা হবে। সমাজে ইসলামের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারে বিশ্বাস করে এমন জনগণ ইসলামপন্থি দলগুলোকে সমর্থন করবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। এ জোট গঠনের উদ্দেশ্যে গত ২০ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে কওমি মাদরাসাভিত্তিক কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। দলটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, মূলধারার সাতটি ইসলামী দলের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। এর পাশাপাশি জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, কয়েকটি অনিবন্ধিত ইসলামী দল এবং গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্যাতনের শিকার আলেম-ওলামাদের সঙ্গে যৌথ মতবিনিময় করেছেন। বৈঠক শেষে এক বিজ্ঞপ্তিতে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ইসলাম কায়েমের জন্য ছোটখাটো মতভেদ ভুলে ভ্রাতৃত্ববোধ, ভালোবাসা, সম্মান ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’ সূত্র জানায়, সম্প্রতি খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলামী পার্টি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, খেলাফত আন্দোলন, জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে জোট করার বিষয়ে যোগাযোগ বাড়িয়েছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ দায়িত্বশীল নেতারা। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে গিয়ে দলটির আমীর সৈয়দ মুফতি রেজাউল করিম চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতের যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হক। এসব বৈঠক ও আলোচনায় নির্বাচনে ‘ইসলামী জোট’ করার বিষয়টি উঠে এসেছে। এবার জোট করার ব্যাপারে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্য দলগুলোর সঙ্গে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব হাফেজ মাওলানা ইউনুস আহম্মেদ শেখ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সব ইসলামী দল মিলে একটি জোট করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। গত রোববার খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে। কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় জোট গঠন করা যায়, কীভাবে সামনে এগিয়ে নেয়া যায় সে বিষয়েও আলোচনা হচ্ছে। যাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে সবাই আগ্রহ দেখিয়েছেন।’ এ জোটে জামায়াতে ইসলামী থাকবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জোটের বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ইসলামী দল মিলে ঐক্য গঠন করার চেষ্টা করছি। আশা করছি এ জোট একটি কার্যকর ঐক্য হবে। শুধু ইসলামী দল নয়, যারা ইসলামী আদর্শ কায়েম করতে চায় তাদের নিয়েই এই ঐক্য গঠন করা হবে। জনগণও চায় সব ইসলামী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করুক। তাই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সব ইসলামী দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে চাই। সেই লক্ষ্যেই সব ইসলামী দল মিলে ঐক্য গঠনের আলোচনা হচ্ছে।’ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ইসলামী দলগুলো মিলে একটি ঐক্য গঠনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে শুনেছি। হেফাজতে ইসলাম একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। তবে দেশের সব ইসলামী দল এক হয়ে ‘নির্বাচনি জোট’ গঠন করলে তাতে কোনো আপত্তি নেই। হেফাজতের অনেক নেতা রাজনৈতিক দলে যুক্ত রয়েছেন। দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য থাকতে পারে, তবে দেশ ও জাতি এবং ইসলামের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দলগুলোর এক হওয়া উচিত।’ তিনি জানান, ঐকমত্যে পৌঁছাতে পরামর্শ বা সহযোগিতা দরকার হলে তা দিতে তারা প্রস্তুত রয়েছেন।

এদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয় বিএনপি। ৯ ডিসেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জোটের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে শরিকদের এমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়। শরিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে যার যার জায়গা থেকে বা জোট গঠন করে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার অনুরোধ করে বিএনপি। তবে জোট ভাঙা নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়া হয়নি। এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা না বলতে শরিকদেরও অনুরোধ করেছে বিএনপি। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে এ মুহূর্তে আমরা আর জোটবদ্ধ নাই। আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এটা এখন কোনো কাজ করে না।’

অন্যদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই। তিনি আরো বলেন, গত আন্দোলনে বিএনপি থেকে জোট না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতারা। তাই তাদের সঙ্গে এখন আমাদের কোনো দলীয় জোট নেই। তবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় আছে, থাকবে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এটা রক্ষা করে চলব। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসা হয় এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।’

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের। একসঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন ও নির্বাচন সবই তারা করেছে। বিএনপি ও জামায়াত জোট একবার সরকারও গঠন করেছে। সে সরকারে জামায়াতের নেতারা মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা হতে চলছেন। ইতোমধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা।

১৯৯৯ সাল থেকে জোটবদ্ধ বিএনপি ও জামায়াতের জোট ২০২২ সালে ভেঙে যায় বলে সে বছরের অক্টোবরে একটি রুকন সম্মেলনে প্রকাশ করেন শফিকুর রহমান। পরে ৯ ডিসেম্বর মির্জা ফখরুল স্বীকার করেন, তারা ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছেন। তবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যোগাযোগ সব সময়ই ছিল, যুগপৎ কর্মসূচিও দিয়েছে দুই দল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি ও জামায়াত একসঙ্গে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে ও বঙ্গভবনে গিয়ে বৈঠক করেছে, ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের শপথ অনুষ্ঠানেও অংশ নেয় তারা।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ