বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতে সরকারের বিপুল বকেয়া জমেছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাবদ সরকারের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০৭ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন ডলার বা ৬০ কোটি ডলারের বেশি। এই বকেয়া পরিশোধ না করায় নতুন করে এলএনজি কেনা বন্ধ আছে। এতে গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় ঘাটতিতে ব্যাপক লোডশেডিং চলছে সারা দেশে। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। মানষের ভোগান্তির সঙ্গে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জ্বালানি সংকট।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি। দেশে ব্যবহূত এসব জ্বালানির শতকরা ৬০ ভাগই আমদানি করতে হয়। এখন জ্বালানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে কয়েক দিন ধরেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমেছে।
দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে কমপক্ষে ২ হাজার মেগাওয়াট। ফলে ব্যাপক মাত্রায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
ডলার-সংকটের কারণে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় এলএনজির পরিশোধ করা যায়নি। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন সচল রাখতে প্রয়োজনীয় জ্বালানির নিশ্চয়তা এবং বকেয়া অর্থ চাইছে। কিন্তু সরকারের কাছে ডলারের ঘাটতি থাকায় তা মেটানো যাচ্ছে না। এখন জ্বালানি সংকট তীব্র হওয়ার এটা বড় কারণ। ৮ মাস ধরেই এ পরিস্থিতি চলতে থাকায় মজুদ জ্বালানিও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আদানি গ্রুপ বকেয়া শোধের তাগিদ দিয়ে চিঠি দিয়েছে।
এলএনজি আমদানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর কাতার এনার্জিকে এর একটা ছোট অংশ (আড়াই কোটি ডলার) পরিশোধ করেছে সরকার। জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বাকি ৬০ কোটি ডলার দ্রুত পরিশোধের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এর আগে আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে কাতার এনার্জির দুটি বিল গত মে ও জুলাই মাসে পরিশোধ করেছিল জ্বালানি বিভাগ। মে মাসে আইটিএফসির সেই ঋণের একটি কিস্তিও বকেয়া পড়ে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন মতে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন কোম্পানি শেভরনের মোট সাতটি বিল বকেয়া পড়েছে। শেভরনের সরবরাহ করা গ্যাসের বকেয়া জমেছে ২২৪.৮২ মিলিয়ন ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটিকে ৩.৪২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। গত বুধবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাকি অর্থ পরিশোধ করার অনুরোধ করেছেন শেভরনের কর্মকর্তারা।
চুক্তির বাইরে দ্রুত সরবরাহ পেতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া, গানভর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড ও এক্সেলারেট এনার্জির মাধ্যমে গ্যাস কিনেছে জ্বালানি বিভাগ। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্যাসের দামের ৮৭.২০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। জানা গেছে, বকেয়ার অঙ্ক বেশি থাকায় ২ ও ৯ সেপ্টেম্বর দুই কার্গো এলএনজি খালাস না করে সরবরাহকারীরা ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ পর্যন্ত নিয়েছিল। পরে জ্বালানি বিভাগ জরুরিভাবে অনুরোধ করে তা খালাসের ব্যবস্থা করে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন চলাকালে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক সময়মতো হয়নি। এ কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কয়েকটি প্রস্তাবের অনুমোদন আটকে ছিল। আন্দোলন ঠেকাতে বিগত সরকার দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় বিদেশের সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। এর ফলেও বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। কয়েক মাস আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কক্সবাজারের দুটি ভাসমান স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মধ্যে একটি অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে আমদানি করা এলএনজি খালাসের সক্ষমতাও অর্ধেকে নেমে আসে। গত বুধবার থেকে দুটি এফএসআরইউ সচল হয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এগুলোর মাধ্যমে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সংকট কাটাতে দ্রুত জ্বালানি আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর কিছু আসবে দীর্ঘমেয়াদি প্যাকেজে। আর কিছু আসবে তাৎক্ষণিক কেনার স্পট মার্কেট থেকে। উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে জ্বালানি আসা শুরু হবে। এই জ্বালানি এলেই পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে কিছু পেমেন্ট হয়েছে। এটি চলমান থাকবে। তবে এই বকেয়া শুধু জ্বালানির ক্ষেত্রেই নয়। সারসহ আরো নানা রকম বকেয়া আছে। এর মধ্যেই আমরা যতটা পারি সমন্বয় করার চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, ‘অর্থনীতির চক্রাকার তৎপরতাকে সচল রাখার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। একইভাবে চাহিদামাফিক বিদ্যুতের সরবরাহ দেয়া। তাই সরকারের এখন উচিত, সব উন্নয়ন প্রকল্পের বিনিয়োগ স্থগিত এবং সেই অর্থ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে জ্বালানি খাতে বরাদ্দের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের পথ তৈরি করা।’
জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে আনা এলএনজির বিল ছাড়াও স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজির জুলাই-আগস্টের বিলও বকেয়া রয়েছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এলএনজি আমদানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল ৬৩৩ মিলিয়ন ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোলিয়াম কোম্পানি কাতার এনার্জিকে ২৫.৬১ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পরিশোধ করেছে সরকার। এতে বকেয়া কমে ৬০৭.৩৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
কর্মকর্তারা জানান, ডলার সরবরাহের মাধ্যমে এসব বকেয়া বিল দ্রুত পরিশোধ করার ব্যবস্থা নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে জ্বালানি বিভাগ। বর্তমাসে দেশে গ্যাসের সংকট বেড়েছে। ডলার সংকটের কারণে এলএনজি আমদানির বকেয়া বাড়ার কারণ ছাড়াও ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক না হওয়ার কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির অনুমোদন আটকে ছিল। গ্যাস সংকটের কারণে বর্তমানে বিদ্যুৎ সংকটও প্রকট রূপ ধারণ করছে। কারণ, অনেক প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ঠিকমতো পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কক্সবাজারের দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মধ্যে একটি অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে আমদানি করা এলএনজি খালাসের সক্ষমতাও অর্ধেকে নেমে আসে। গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে দুটি এফএসআরইউ সচল হয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এ দুটি এফএসআরইউয়ের মাধ্যমে দৈনিক ১,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বকেয়ার পরিমাণ বেশি থাকায় গত ২ সেপ্টেম্বর ও ৯ সেপ্টেম্বর দুই কার্গো এলএনজি খালাস না করে সরবরাহকারী দেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। জ্বালানি বিভাগ জরুরিভাবে অনুরোধ করে তা খালাস করার ব্যবস্থা করেছে।’ ওই কর্মকর্তা জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্রতর হলে জুলাই ও আগস্টের শুরুতে ব্যাংক ও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিদেশের সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। ফলে বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। বর্তমানে বকেয়া দায় পরিশোধের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মার্কিন কোম্পানি শেভনের সরবরাহ করা গ্যাসের বিল বাবদ ২২৪.৮২ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে। পরদিন কোম্পানিটিকে সর্বশেষ ৩.৪২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে শেভরনের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২২১.৪০ মিলিয়ন ডলার।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাতার এনার্জির বকেয়া বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৪ মিলিয়ন ডলার ও ওমান ওকিউটির বকেয়া দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর সরকার কাতার এনার্জিকে ৬.১৯ মিলিয়ন ডলার ও ওমানকে ৩ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ঋণ নিয়ে কাতার এনার্জির দুটি বিল গত মে ও জুলাই মাসে পরিশোধ করে জ্বালানি বিভাগ। মে মাসে আইটিএফসির সেই ঋণের একটি কিস্তিও বকেয়া পড়েছে।
স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া, গানভর সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড ও এক্সেলারেট এনার্জির মাধ্যমে গ্যাস কিনেছে জ্বালানি বিভাগ। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা গ্যাসের ৮৭.২০ মিলিয়ন ডলার এখনো বকেয়া রয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ