ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শ্যালক কেরামতিতে এমডি!

প্রকাশনার সময়: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০

প্রবাদ রয়েছে ‘তদবিরে তকদির খোলে’। আর এটিই বাস্তবে রূপ পেয়েছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগের ক্ষেত্রে। এ পদে নির্ধারিত প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সংশোধন করা হয়েছে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। জুড়ে দেয়া হয়েছে নির্ধারিত প্রার্থীর থাকা যোগ্যতাকে। চলতি বছরের শুরুতে দেয়া বর্তমান এমডির নিয়োগ নিয়ে এমনটাই অভিযোগ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত এমডি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, এ ধরনের সংস্থার নিয়োগ প্রফেশনালি সংশ্লিষ্ট ফিল্ডের হতে হবে। এটা ইচ্ছামাফিক পরিবর্তন করার সুযোগ থাকা উচিত নয়। যেহেতু ডিপিডিসির অধিকাংশ কাজ হয় টেকনিক্যাল তাই এখানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের আসার কোনো যৌক্তিকতা নেই পাশাপাশি এ ধরনের লোকদের নিয়োগ দেয়ারই বা দরকার কী। এটা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। এ ধরনের লোক যারা নিয়োগ দেয় তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তিনি বলেন, ফিল্ডের সংশ্লিষ্ট কাজের লোকের তো অভাব নেই। সুতরাং এ ধরনের লোককে দিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি না করাই ভালো। অভিযোগ রয়েছে, ডিপিডিসির বর্তমান এমডি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমানের শ্যালক একাত্তর টিভির সিইও এবং প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল হক বাবুর তদবিরে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সংস্থার প্রকাশিত এমডি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সংশোধন আনা হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল মোজাম্মেল হক বাবুর আপন ভগ্নিপতি আব্দুল্লাহ নোমানকে (বর্তমান এমডি) ডিপিডিসিতে এমডি পদে নিয়োগ দেয়া। আর এ লক্ষ্যে প্রভাবশালী মোজাম্মেল হক বাবু তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে তদবির শুরু করেন। নিয়োগে প্রধান অন্তরায় ছিল বর্তমান এমডি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান নন টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। অর্থাৎ তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আর ডিপিডিসির এমডি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তবে মোজাম্মেল হক বাবুর তদবিরে ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটিতে সংশোধন করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদেরও আবেদন করার সুযোগ করে দেয়া হয়। এর ফলে প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমানকে ডিপিডিসির এমডি পদে নিয়োগ দেয়ার পথ সুগম হয়ে যায়। এ যেন শ্যালকের কেরামতিতে ভগ্নিপতিকে ডিপিডিসির এমডি পদে নিয়োগ প্রদান।

অভিযোগে আরো প্রকাশ, প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান নন টেকনিক্যাল হওয়ায় ডিপিডিসির কতিপয় সুবিধাবাদীরা তাদের ইচ্ছামাফিক সংস্থা পরিচালনা করে আসছে। আর সুযোগ নিচ্ছে ডিপিডিসিতে ঘাপটি মেরে থাকা এই দুষ্টচক্র। পাশাপাশি সেই সুবিধাবাদীরা হয়রানি করছে সংস্থার শুভাকাঙ্ক্ষী ও যোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিশেষ করে এই চক্রে সংস্থার দু’জন নির্বাহী পরিচালকের এ ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন। এই চক্রটি এমডিকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে অনেক সময়ই ভুল পথে পরিচালনা করে নিজেরা বিভিন্ন ধরনের বদলি-পদোন্নতিসহ নানা অনৈতিক বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এ নির্বাহী পরিচালকদ্বয়ের একজন তার এসব ঘুষের টাকা নিকটাত্মিয়ের নামে রাজধানীর গুলশান এলাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে তাতে জমা রাখছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে ডিপিডিসির এমডি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান এ বিষয়ে বলেন, যে কোনো কারিগরি সিদ্ধান্ত হয় কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেমন- আমাদের পরিকল্পনা বিভাগ আছে, সেখান থেকে কারিগরি বিষয় বিবেচনা করে এরপর সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়। তাছাড়া নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং ও অপারেশন আছে তারা বিষয়গুলোকে যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করার পরে এগুলো অনুমোদন হয়। আমি এমডি হিসেবে কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে নেই না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সংযুক্ত করা হয়েছে অনেক আগেই। আমি যখন পিডিবিতে চাকরি করি তখনই এই সংশোধনটি হয়েছে। তখন তো আমার এমডি হওয়ার বিষয় ছিল না। সুতরাং আমার জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করা হয়েছে এটা ঠিক নয়। বেশ কিছুদিন ধরেই এক শ্রেণির মানুষ এ প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে বলে দাবি তার।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিপিডিসির একাধিক সূত্রের দাবি, সংস্থার প্রায় সব কার্যক্রমই টেকনিক্যাল, তাই এসব বিষয়ে নির্দেশনা দিতে কিংবা যথোপযুক্ত কাজ করাতে অবশ্যই টেকনিক্যাল কর্মকর্তা প্রয়োজন। নতুবা এ সুযোগে দুষ্টচক্র তাদের ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলে মরিয়া হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।

সূত্রের দাবি, যেহেতু বর্তমান এমডি প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান নন টেকনিক্যাল তাই তিনি যে কোনো টেকনিক্যাল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। আর এ সুযোগে দুষ্টচক্র সংস্থার স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থের প্রধান্য দিয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে মরিয়া থাকে। ফলে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েই যায়।

সূত্রের দাবি, বর্তমান এমডির আমলেই সুবিধাবাদী চক্রের পরামর্শে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ডিপিডিসির খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদে। ডিপিডিসির খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পে অপরিপক্বও জুনিয়র কর্মকর্তাকে পিডি হিসেবে দায়িত্ব পাইয়ে দিয়ে নিজেদের অনৈতিক ফায়দা লোটাই ছিল এ চক্রের মূল উদ্দেশ্য। এর নেপথ্যে আবার মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তারও যোগসাজশ রয়েছে। এর আগে বিশেষ গোপন অনৈতিক কারণে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে একই ব্যক্তিকে প্রধান প্রকৌশলী পদেও পদোন্নতি দেয়া হয় বলে সূত্রের দাবি।

অভিযোগে আরো প্রকাশ, একজন নির্বাহী পরিচালক ডিপিডিসিতে যোগদানের পর থেকেই সাংবাদিকদের নিয়ে বিষোদগার ও সাংবাদিক বিদ্বেষী কথা বলে যাচ্ছেন। এমনকি চলতি বছরে যোগদানকৃত এ নির্বাহী পরিচালক কতিপয় প্রকৌশলীদের সঙ্গে এক জুম মিটিং-এ সাংবাদিকদের নিয়ে বিষোদগার করেছেন। তাদের কাউকে কাউকে এমন কথাও ওই নির্বাহী পরিচালক বলেছেন সাংবাদিকদের প্রশ্রয় দেবেন না, কোনো ঝামেলা হলে আমি দেখব। যার ফলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে এমন অপেশাদার নির্বাহী পরিচালকের খুঁটির জোর কোথায়? এমনিতেই কথায় আছে ‘ছাগল লড়ে খুঁটির জোরে’।

প্রসঙ্গত: ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে গত ৪ ফেব্রুয়ারি যোগদান করেছেন প্রকৌশলী আবদুল্লাহ নোমান। দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। তিনি ইতোপূর্বে অত্র প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসিতে নির্বাহী পরিচালক (আইসিটি এন্ড প্রকিউরমেন্ট) পদে কাজ করেছেন।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ