এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় নিবন্ধিত প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে গণবিজ্ঞপ্তি দেয় এনটিআরসিএ। নিয়ম অনুযায়ী ১৭তম নিবন্ধন পরীক্ষার পর কিছুদিন আগে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সেখানে মোটামুটি ভালো নম্বর পাওয়া প্রার্থীদের চাকরি হয়ে গেছে। এমনকি ন্যূনতম (৪০-৪২) নম্বর পেয়েও সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন অনেকে। যারা বাদ পড়েছেন, তারা মেধার বিবেচনায় একদমই পিছিয়ে। পরবর্তী গণবিজ্ঞপ্তি হওয়ার কথা ১৮তম নিবন্ধন পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর। ১৮তম নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর এনটিআরসিএ ঘোষণা করেছিল সেপ্টেম্বর মাসে ফল প্রকাশ করবে। সে অনুযায়ী মাসখানেকের মধ্যেই ১৮তম নিবন্ধনের ফল প্রকাশ হওয়ার কথা এবং এর পরপরই পরবর্তী গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এ ফল প্রকাশকে একদম মুখোমুখি অবস্থানে রেখেই ১-১৭তম নিবন্ধনে যারা কম নম্বর পাওয়ার কারণে আগের গণবিজ্ঞপ্তিগুলোতে আবেদন করেও নিয়োগপ্রাপ্ত হননি বা যাদের বয়স ৩৫-এর ওপরে চলে গেছে তাদের নিয়োগের সুযোগ দিতে তড়িঘড়ি করে এনটিআরসিএ আরেকটি বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি দেবে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।
এ খবর শোনার পরদিন এনটিআরসিএর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ফল প্রত্যাশী হবু শিক্ষকরা। তারা এনটিআরসিএ চেয়ারম্যান ও শিক্ষা উপদেষ্টা বরাবরও স্মারকলিপি প্রদান করে। অপেক্ষাকৃত কম নম্বর পাওয়া একদম দুর্বলদের বা বয়স পেরিয়ে যাওয়াদের শিক্ষক বানাতে যে বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি দিতে চাচ্ছে এনটিআরসিএ তাতে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হবে।
প্রথমত, পূর্বের গণবিজ্ঞপ্তিগুলোর মাধ্যমে নিবন্ধিত ভালো নম্বরধারী মেধাবীরা নিয়োগ পেয়ে গেছে। এমনকি ৪১ নম্বরেও চাকরি হয়েছে। যারা বাদ পড়েছেন তারা নম্বরে একদমই পিছিয়ে। বারবার সুযোগ পাওয়ার পরও যাদের নম্বর একদমই কম, থাকায় সুপারিশপ্রাপ্ত হতে পারেনি তাদের বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুযোগ দেওয়া মানেই দুর্বলদের শিক্ষকতায় আসার সুযোগ করে দেওয়া। তাড়াহুড়া করে তাদের নিয়োগ দিলে একদম দুর্বলরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হয়ে আসবে।
তীব্র সংকটের অজুহাতে যারা এতবার সুযোগ দেওয়ার পরও কম নম্বরের কারণে নিয়োগ পাননি তাদের কেন নিয়োগ দিতে হবে? নিচে পড়ে থাকা টেনেটুনে ৪০ পাওয়া, বয়স পেরিয়ে যাওয়া লোকটিকে কেন নিয়মবহির্ভূত গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে নিয়োগ দিতে হবে? দুর্বলদের অন্য পেশায় বিবেচনা করা যায়, শিক্ষকতায় নয়। শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সবচেয়ে মেধাবীকেই বিবেচনা করতে হয়। কারণ, শিক্ষক দুর্বল তো শিক্ষাব্যবস্থা দুর্বল, আগামীর প্রজন্ম দুর্বল। বিষয়টি এমন নয় যে, এ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে অল্প কিছুদিনের জন্য। আবার এমনও নয় যে, ১৮তম নিবন্ধনের ফল প্রকাশ করতে দু-চার বছর লেগে যাবে। বরং যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে, তিনি তো সারা জীবন এখানে কাজ করবেন। আবার একমাস অপেক্ষা করলেই একঝাঁক মেধাবী শিক্ষক পাবে জাতি। ২০-৩০ বছরের জন্য যে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে তাকে তো সর্বোচ্চ মেধাবী দেখেই নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। এখন যে শিশুটি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, সে চাকরির পরীক্ষায় বা আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে মোটামুটি ১০-১২ বছর পর। ১০-১২ বছর পর প্রতিযোগিতা আরো বাড়বে। সে সময়ের প্রতিযোগিতায় টেকার মতো যোগ্য করে আমাদের প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষক দিয়ে কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া এখন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক তো পরবর্তী ২০-২৫ বছর পাঠদান করবেন। এখন থেকে ২৫ বছর পরের যে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতায় যে উন্নতমানের পাঠদান প্রয়োজন তা মেধায় পিছিয়ে থাকা একজন শিক্ষক কীভাবে করবেন? এজন্য এখন যাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে, ১-২ মাস অপেক্ষা করে হলেও সর্বোচ্চ মেধাবীকেই নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয়ত, এভাবে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে ছাত্রসমাজে অসন্তোষ দেখা দেবে, আন্দোলন হলে দুষ্কৃতকারীরা সুযোগ নিতে চাইবে। দেশের এ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের আন্দোলনের সুযোগ করে দেওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না। ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২০ সালে, সে হিসেবে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তি হওয়ার কথা ২০২১ সালে কিন্তু সে বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০২৩ সালের শেষে, প্রায় এক বছর শেষ হতে চলল তবুও ১৮তম-এর কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি। মূলত এনটিআরসিএ একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠান। কারণ তারা শিক্ষক সংকট দূর করতে পারেনি, তাদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এ ‘বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি’ দিতে চাচ্ছে। স্বৈরাচারের কোনো দোসর ছাত্রদের আন্দোলনে নামিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে কি-না তা খতিয়ে দেখা দরকার। অভিযোগ রয়েছে, এনটিআরসিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে নিবন্ধনের জাল সনদ দেওয়া হয়েছিল, আবার তারাই মোটা অঙ্কের টাকা খেয়ে ১-১৫তম নিবন্ধনে পাস করা এবং বয়স পেরিয়ে যাওয়া প্রার্থীদের নিয়োগ দিতে চাচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা দরকার।
১-১৫তম নিবন্ধনে পাস করেও বাদ পড়াদের ৫ম গণবিজ্ঞপ্তিতে সুযোগ দেওয়া হয়নি। সেখানে সুযোগ না দিয়ে এখন কেন তাদের সুযোগ দেওয়া? মানবিক কারণে যদি সুযোগ দিতেই হয়; তাহলে সর্বোচ্চ ১৭তম নিবন্ধনে ভালো নম্বর পেয়েও যারা বয়স পেরিয়ে যাওয়ায় আবেদনে সুযোগ পাননি কেবল তাদের একবার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে এনটিআরসিএ চাইলে পদ খালি করেও নিয়োগ দিতে পারে।
গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেশে ৬০ হাজার শিক্ষক জাল সনদে চাকরি করছেন। (ঢাকা টাইমস: ৫ মার্চ, ২০২৪)। জাল সনদে ১১৫৬ শিক্ষকের চাকরির খবর উঠে আসে আরেক প্রতিবেদনে। (কালের কণ্ঠ: ১৪ জুলাই, ২০২৪)। জাল সনদ বা অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এসব শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে এর স্থলে কেবল ১৭তমতে বয়সজনিত কারণে যারা নিয়োগবঞ্চিত হয়েছেন, তাদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কারণ, ২০২০ সালে ১৭তম নিবন্ধন পরীক্ষা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ফল প্রকাশ করে ২০২১ সালে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার কথা। কিন্তু এনটিআরসিএ’র ব্যর্থতায় সে গণবিজ্ঞপ্তি হয় ২০২৪ সালে। এতেই অনেকের বয়স পেরিয়ে যায়। ফলে ভালো নম্বর পেয়েও তারা আবেদন করতে পারেননি।
এনটিআরসিএ বলেছিল, এ মাসের মধ্যেই ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে। তাহলে মাত্র ১ মাস অপেক্ষা করলেই তো মেধাবীদের পাচ্ছে এনটিআরসিএ। তাই তাড়াহুড়া করে বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে দুর্বলদের শ্রেণিকক্ষে না এনে সমস্যার সমাধানে দ্রুত ১৮তম’র ফল ঘোষণা করে মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হোক।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ