ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সংকটে বিদ্যুৎ খাত

প্রকাশনার সময়: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২২

একের পর এক অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। জ্বালানি চাহিদাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে প্রতিবছর বড় সময় অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিতে হয়েছে অলস কেন্দ্রের ভাড়াও। খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়িয়েছে সরকার। অথচ তিন বছর ধরে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ে ভুগতে হচ্ছে মানুষকে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েও পড়েছে একই সমস্যায়। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই। ফলে বেড়েছে লোডশেডিং। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একমাত্র সচল ইউনিটও বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যে অচিরেই উৎপাদনে যেতে পারবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ফলে বড় সংকটে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত।

গত সোমবার গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং করতে হয়েছে। চার দিন ধরে বাড়ছে লোডশেডিং। ঢাকার বাইরে কোনো কোনো এলাকায় গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। যদিও দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম।

দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া হয়। কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট।

সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের উত্তরের ১৬ জেলায় নেসকো ও পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা দুই হাজার ৬০০ থেকে দুই হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। সরবরাহ মিলছে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে ৯০০ মেগাওয়াটেরও বেশি। এরই মধ্যে রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকোর কাছে চাহিদা এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সেখানে মিলছে ৮০০ মেগাওয়াটেরও কম। ঘাটতি ৪০০ মেগাওয়াটের ওপরে। তবে জেলা শহরের বাইরে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে বিদ্যুৎ একেবারে থাকছে না বললেই চলে।

সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামে এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় এটিএম বুথ, স্টুডিও, ওয়েলডিং কারখানাসহ ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে অনাবৃষ্টিতে আমন ক্ষেতে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সেচ ব্যবস্থা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। সেচ প্রকল্পের বেশির ভাগ গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত হওয়ায় লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়ছে।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, লোডশেডিং চলছে জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনেও। পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকাগুলোতে দিনে রাতে এক ঘণ্টা পরপর চলছে লোডশেডিং। আবার কোথাও কোথাও লোডশেডিংয়ের মাত্রা তার চেয়েও বেশি। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন গ্রামাঞ্চলের গ্রাহকরাও।

জানা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে অনাবৃষ্টির কারণে আমন খেতে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সেচ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেচ প্রকল্পের বেশির ভাগ গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত হওয়ায় আমন চাষে লোডশেডিংয়ের প্রভাব পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক কৃষক ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে জমিতে সেচ দিচ্ছেন।

এদিকে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একমাত্র সচল ইউনিটও বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যে অচিরেই উৎপাদনে যেতে পারবে, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে আভাস মিলেছে কেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিকের কথায়। তিনি বলেন, একটি টারবাইন চালাতে দুইটা ইলেকট্রো হাইড্রলিক ওয়েল পাম্প লাগে। ২০২২ সালে একটি ইলেকট্রো হাইড্রলিক ওয়েল পাম্প নষ্ট হয়ে যায়।

তখন থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয়া হলেও তারা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেনি। ফলে একটা পাম্প দিয়েই এতদিন ইউনিট চালু ছিল। সেই একটা পাম্পও সোমবার নষ্ট হওয়ায় পুরো প্লান্ট বন্ধ হয়ে গেছে। কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ১২৫ মেগাওয়াট করে। এর মধ্যে ২ নম্বর ইউনিটটি বন্ধ আছে ২০২০ সালের শেষভাগ থেকে। আর ১ নম্বর ইউনিটে বর্তমানে সংস্কার কাজ চলমান আছে। গত সোমবার বন্ধ হওয়া তৃতীয় ইউনিটের সক্ষমতা ২৭৪ মেগাওয়াট হলেও সেটি ১৯০ থেকে ২১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছিল।

আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, চুক্তিবদ্ধ চীনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হারবিন ইলেক্ট্রিক ইন্টরন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ পাঠাতে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫ বছরের চুক্তি আছে যে, তারা সব খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করবে। কিন্তু গত ৪ বছরে একটি যন্ত্রাংশও সরবরাহ করেনি। তাদের বারবার চিঠি দিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। চুক্তি থাকার কারণে ওই খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে পারছি না।

কবে নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হতে পারে— এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সোমবারও কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, যন্ত্রাংশ সরবরাহে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। বাংলাদেশে এই যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না, ফলে তা কেনাও যাচ্ছে না। এতে করে কবে নাগাদ বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব না।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ, তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা। তাদের বিদ্যুৎ বিল পাওনা দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি ডলারের (প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা) বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) পরিশোধের নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। বকেয়া বিল পরিশোধে চাপ দিচ্ছে তারা। কেন্দ্রটির কয়লা আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এতে উৎপাদন কমিয়ে এক হাজার মেগাওয়াটে আনা হয়েছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি হলে লোডশেডিং বেশি করা হয় গ্রামাঞ্চলে। ঘাটতি অনেক বেশি হলে রাজধানী ঢাকায়ও লোডশেডিং করতে হয়। ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)।

এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত সোমবার বিকাল চারটা থেকে ডিপিডিসি ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে। আর সন্ধ্যায় ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে ডেসকো। এর বাইরেও দিনের বিভিন্ন সময় কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ-বিভ্রাটের খোঁজ পাওয়া গেছে।

ব্যাপক লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নেয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করা হয়, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এ আইনের অধীন দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথমে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্ত হলেও পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে থাকেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি, উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ গুণ। আর কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় দেখা গেছে, ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।

এই পরিস্থিতিতে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে সরকার চেষ্টা করছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি ও কয়লা আমদানি করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে সভা হবে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫ কোটি টাকা।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ