মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

কতটুকু সহানুভূতি সাকিবের পাওনা?

প্রকাশনার সময়: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৪১

গত ৫ আগস্ট গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা রেজিমের পতনের পর তাঁর এবং তাঁর সভাসদদের বিরুদ্ধে ঝড়ের বেগে রাজনৈতিক মামলা ধেয়ে আসছে। এটিই বাংলাদেশের পরম্পরাগত রাজনৈতিক ঐতিহ্য। আমাদের আলাপের ফোকাস পারসন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। এ লিজেন্ডারি খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। বিচারাধীন বিষয়ে আমাদের মন্তব্য করা নিষেধ। তবে আমরা এটা বলতে পারি খেলোয়াড় সাকিব যেহেতু আওয়ামী রেজিমের ফ্যাসিলিটিজ গ্রহণ করেছেন, কাজেই তাঁকে সসম্মানে আওয়ামী লীগের সব লায়াবিলিটিজও গ্রহণ করতে হবে। সাকিব যেহেতু বলতে পারেননি যে, আপনি তো রাতের ভোট বা ডামি ভোট করে একতরফা ক্ষমতা চর্চা করছেন, সেহেতু এ কথা বলার আর সুযোগ নেই যে, আমি তো দেশের বাইরে ছিলাম; আমি কেমনে মার্ডার কেসের আসামি হই?

আমরা কোনোভাবেই বলছি না যে, এ মামলাগুলো রাজনীতিতে কোনো ভালো নজির স্থাপন করছে। ঢালাও মামলার পক্ষপাতি আমরা না। কিন্তু নেতার দায় অনুসারীদের ওপর বর্তায় বটে। এসব মামলার ব্যাপারে ব্যারিস্টার সারা হোসেনের সঙ্গে আমরা একমত। সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা প্রসঙ্গে ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মামলা কি পুলিশ করছে? সৎভাবে করছে? বুঝে করছে?’ এ ব্যাপারে অধিকতর আলাপ রাজনৈতিক ভাষ্যকার, আইনজ্ঞ ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা করবেন। আমরা সাধারণের বোধের বাইরে এসব।

২০২২ সালের আগস্টে ক্রিকেট ব্যাটিং ও ক্যাসিনোর ওয়েবসাইট ‘বেটউইনার’-এর সঙ্গে ১০ কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। সেসময় আমরা লিখেছিলাম— হাউ মাচ মানি ডাজ অ্যা ম্যান নিড?

রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের একটি বিখ্যাত গল্প আছে। কতটা জমি দরকার। How much land does a man need.. ওই গল্পের প্রোটাগনিস্ট অনেক জমির লোভী পাখোম কিনা পেয়েছিল মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি। যেখানটায় তাকে সমাহিত করা গিয়েছিল।

আজ আমরা যারা সাকিবে সিমপ্যাথাইজ, তারাও দেখল সাকিবের জীবনেও এক ধরনের গ্রেভইয়ার্ডের নীরবতা নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সফরে থাকা সাকিবকে জাতীয় দল থেকে বাদ দিয়ে মামলার তদন্তের স্বার্থে দেশে ফিরিয়ে আনতে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

সাকিব আল হাসান নিঃসন্দেহে গেল দশক ধরেই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সুপরিচিত ক্রিকেট বোদ্ধা এবং ক্রিকেট লাভাররা সাকিবকে ভালোভাবেই চেনেন। এমন পপুলার ও মেধাবী ক্রিকেটারই কি-না অতীতে এমন সব কাণ্ড কারখানায় নামাঙ্কিত করেছেন; যেটি সভ্যমহলে গ্রহণযোগ্য হয়নি। সাকিব ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন। তাঁর নামের পাশে অনেক অনেক রেকর্ডের ঝলকানি। ওই ঝলকটাতে কালিমা লেপন করে গেছে তাঁর বেশ কিছু সবার জানা অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে বিসিবি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হিসেবে জাতীয় দলের ক্রিকেটার হয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের এমপি বনে যাওয়াটা তাঁর জীবনে কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ অধ্যায়ের রচয়িতা তিনি নিজে। একটি টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রির ‘ক্রিকেট লিজেন্ড’ এত বড় তকমা গায়ের সঙ্গে লেগে থাকার পর একজন মানুষের আর কী লাগে? পৃথিবীতে নিজের পদচিহ্ন রেখে যেতে আর কী কী করতে হয় আসলে?

সাকিবের খেলোয়াড়ি প্রতিভাকে সম্মান করে না, ভালোবাসে না— এমন মানুষ বাংলাদেশে খুব কম। তাঁর প্রতি অবোধ ও অবুঝ শিশুদেরও যে প্রেম তা অতুল্য অবিশ্বাস্য। সাকিব আল হাসান যদি কোনো দলভুক্ত হয়ে সেই সর্বজনীন ভালোবাসার দাম না চুকাতে পারেন— এটি তাঁর আত্মজৈবনিক বড় ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার দায় তাঁকে মেটাতে হবে আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে।

ক্রিকেট যতটা না শারীরিক সক্ষমতার গেইম, তারও অধিক মনস্তাত্ত্বিক খেলা। যে সময়টা ক্রিকেটার সাকিবকে দলের জন্য মনপ্রাণ উজাড় করে দেয়ার কথা, সেসময় রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ নিতে তাঁর দৌড়ঝাঁপ সবার চোখে লেগেছে। আমাদের প্রশ্ন ছিল— সে মাঠের খেলায় মনোযোগী হবে নাকি রাজনৈতিক চাপ সামলাবে? আজকে আমাদের সেই ভাবনটাই সত্য বলে প্রতিভাত হলো।

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি বজায় ছিল, সেখানে ক্ষমতাসীনদের নৌকায় উঠে পাল তুলে দেয়ার দায়িত্ব নেয়া অর্বাচীনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ সময়টায় যেহেতু ক্ষমতাকে জবাবদিহি করা যায়নি, প্রশ্ন করার সৎসাহস কারো ছিল না, গঠনমূলক সমালোচনা করা সংবাদ মাধ্যমগুলো দৌড়ের ওপর ছিল, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের নামে মুক্ত স্বাধীন মতকে কোণঠাসা করে রাখা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহারকারীদের জন্য দুর্নীতি করে অর্থ লোপাট করার সমূহ সুবিধা বিদ্যমান আছে; এমন এক রেজিমের সঙ্গে সর্বত সংহতি জানিয়ে সাকিবের মতো ওই একই কাজ করে নিজেদের স্বাভাবিক ইমেজ নষ্ট করেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস।

যে রাজনীতি টেকসই নয়, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল নয়, যে রাজনীতি সুষ্ঠুধারায় এক্সিট নেয়ার পথ বাতলে দিতে পারে না, খামোখা ওই রাজনীতির সঙ্গে মাখামাখি করে নিজেদের সুন্দর জীবনকে বিপর্যয়ে ফেলার মানে নেই। পরিবারকে পেরেশানিতে ফেলার কোনো যুক্তি নেই। সামনের দিনে যারা নতুন দলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দেখাবেন তাদের জন্যও এটা বড় লেসন।

সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে মামলাটি তাঁর আপন ইচ্ছার অর্জন। খেলোয়াড়ি জীবনটাকে তিনি হয়তো উপভোগ করতে পারছিলেন না। ব্যবসাতেও তাঁর মন বসেনি। মডেলিং করেও স্বপ্ন ছুঁতে পারেননি। তিনি পলিটিশিয়ান হয়ে নিজের যশ খ্যাতিকে অধিকতর মহিমান্বিত ও অর্থপূর্ণ করতে চেয়েছিলেন। কাজেই রাজনৈতিক মামলা দেখে তাঁকে চমকে যাওয়া বা থমকে গেলে চলবে না। ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, জিয়া, এরশাদ, খালেদা— কেউ জীবনে কম মামলা খাননি। সুতরাং আমরা মনে করি মামলার আগুনে পুড়ে গিয়ে নিখাদ স্বর্ণ হয়ে রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকতে হবে সাকিবকে; যদি তিনি রাজনীতি কন্টিনিউ করতে চান। নিজের দলের কর্ম ও কীর্তির দায় এড়ানোর সুযোগ এতটুকু থাকতে নেই কোনো দলবাজ মানুষের।

বিপুল প্রাণের বিনিময়ে গড়ে ওঠা গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ পিছু হটেছে। জুলাই বিপ্লবের ওই পরাজয়ের দায় দলবাজ হিসেবে সাকিব আল হাসানদের বহন করতে হবে বৈকি। আমরা সহানুভূতি জানাতে পারি। ন্যায্য বিচার যেন নিশ্চিত হয়— এ দাবিটুকু করতে পারি। আমরা সমস্বরে এটাও বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগ যে তরিকায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রাজনৈতিক মামলাগুলো হ্যান্ডেল করেছে, বৈষম্যহীন সমাজের দাবিতে গড়ে ওঠা রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে পাওয়া নতুন দিনে সেই একই তরিকা অন্তর্বর্তী সরকারও যেন বয়ে না বেড়ায়।

লেখক: সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ