মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

উদ্যোগেও থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ

প্রকাশনার সময়: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:১০

নানামুখী উদ্যোগেও সাভার ও আশুলিয়ায় থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ। এ পরিস্থিতিতে গতকাল সোমবার ওই এলাকার ৭৯টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে মালিক কর্তৃপক্ষ।

শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, সোমবার বেশকিছু এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ায় ৭৯টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। তিনি আরো বলেন, আগের দিন গত রোববার কয়েকটি পোশাক কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে। এদিন ৪৫টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিন আশুলিয়ায় আলিফ ভিলেজ লিমিটেড গ্রুপের তিনটি তৈরি পোশাক কারখানায় ব্যাপক হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীদের অনেকে মুখোশ পরিহিত ছিল। দুপুরে আশুলিয়া ইউনিয়নের টঙ্গাবাড়ি এলাকার আলিফ ভিলেজ লিমিটেডের আলিফ এমব্রয়ডারি ভিলেজ লিমিটেড, লাম মিম অ্যাপারেলস লিমিটেড ও লাম মিম অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে গত কয়েক দিন নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। কারখানার মালিক, শ্রমিক নেতা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও হয় সমন্বয় সভা। পুরো আশুলিয়ায় নেয়া হয়েছিল ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরপরও আশুলিয়া শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ থামানো যাচ্ছে না।

অন্যান্য দিনের মতো সোমবার সকালে বেশ কয়েকটি কারখানায় যোগ দিয়ে এক পর্যায়ে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান শ্রমিকরা। কারখানার ভেতর তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। শ্রমিক নেতারা বলছেন, অন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা শ্রমিক নয়। কারা আন্দোলন করছে, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। মালিকপক্ষ বলছে, যৌথ বাহিনীর বারবার আশ্বাস দিলেও পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।

পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকের চেয়ে পুরুষ বেশি নিয়োগ দিতে হবে, প্রধান এ দাবিসহ আরো কিছু দাবি নিয়ে ১০ দিন ধরে অসন্তোষ চলছে শিল্পাঞ্চলে। পোশাক কারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। তবে গত কয়েক বছরে নারী শ্রমিকের হার অনেক কমেছে। গবেষণা সংস্থা ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) পরিসংখ্যান বলছে, পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের হার এখন ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এক সময় এ হার প্রায় ৮০ শতাংশ ছিল।

যৌথবাহিনী বারবার আশ্বাস দিলেও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, সমন্বয়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন বলতে এখন কিছুই নেই। আগে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুলিশ ও শিল্প পুলিশকে কখনো আইনি, কখনো কৌশলগত ব্যবস্থা নিতে দেখা গেছে। এখন সেটা একেবারেই নেই। শ্রমিক নেতাদের কথা শুনছে না আন্দোলনকারীরা। রাজনৈতিক বৈরিতাও তৈরি হয়েছে। মোটামুটি এসব কারণেই পরিস্থিতি আশানুরূপ উন্নতি হয়নি।

শ্রমিক নেতাদের মধ্যে বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে পোশাক খাতে মজুরি ইস্যু ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হয়নি। এখন মজুরির বাইরে নানা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন প্রমাণ করে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তার মতে, গত সাড়ে ১৫ বছর একপক্ষ কারখানা থেকে ঝুট, কাটপিস, স্টকলটসহ নানা দিক থেকে সুবিধা ভোগ করেছে। এখন নতুন পক্ষ তৈরি হয়েছে। দু’পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বেও শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চলছে শ্রমিক আন্দোলনের নামে। এদিকে সরকার পতনের পর পোশাক কারখানা এলাকার যে সন্ত্রাসীরা এলাকাছাড়া হয়েছিল, তাদের অনেকে আবার ফিরে এসেছে।

আলিফ ভিলেজ লিমিটেড গ্রুপের আশুলিয়া জোনের ম্যানেজার এইচআর অ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স মো. রেফাই সিদ্দিক বলেন, রোববার সকাল থেকেই তাদের তিনটি তৈরি পোশাক কারখানায় ১৫ শতাধিক শ্রমিক কাজে যোগ দেন। পরে সকাল ১০টার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ লোক মুখে মাস্ক পরে লাঠিসোটা নিয়ে হঠাৎ তাদের তিন কারখানায় একযোগে হামলা করে। এ সময় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা কারখানাগুলোর মূল গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। কারখানার গ্লাস, ডিজিটাল মেশিন, কম্পিউটার, ফায়ার কন্ট্রোল প্যানেল, বিদ্যুতের সাব-স্টেশন, মেডিকেল সরঞ্জাম, সিসি টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, বাগানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করে। এ সময় ভাঙচুরে বাধা দেয়ায় কারখানার নিরাপত্তাকর্মীসহ ২০ জনকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে কারখানা থেকে মূল্যবান পোশাক, ল্যাপটপ, মোটর সাইকেল ও মেশিনপত্র লুটপাট করে পালিয়ে যায়। কয়েক ঘণ্টার হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে কারখানার মালিক, শ্রমিক ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কারখানার যে ডিজিটাল মেশিন দিয়ে এমব্রয়ডারি ও প্রিন্ট করা হয়, সেই মেশিনগুলো ভেঙে ফেলায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে কারখানা তিনটির। কারখানার উৎপাদন চালু করতে মেশিনগুলো আনতে ছয় থেকে আট মাস লাগবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

কারখানায় হামলা-ভাঙচুরে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিন কারখানায় এমন হামলার খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত সন্দেহ কাউকে আটক করতে পারেননি।

এ ব্যাপারে আলিফ ভিলেজ লিমিটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ আকতার হোসেন রানা জানান, তিনি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

টঙ্গীতে শ্রমিক বিক্ষোভ

টঙ্গীতে ঠিক সময়ে বেতন ও ১৩ দফা দাবি নিয়ে গতকালও বিক্ষোভ হয়েছে। গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডের দুটি কারখানার প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কারখানার সামনে বিক্ষোভ করছেন। সোমবার সকাল ৮টা থেকে টঙ্গী পূর্ব থানার পেছনে কেবিএম রোডের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছেন শ্রমিকরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করছেন।

শ্রমিকরা জানান, গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডে দুটি কারখানা আছে। একটি মা টাওয়ারে আরেকটি আলম টাওয়ারে। এ দুই কারখানায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু আমরা আমাদের ন্যায্য কোনো কিছুই পাচ্ছি না। আমরা ১৩ দফা দাবি জানিয়েছি। না হলে কাজে ফিরব না।

গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডের শ্রমিকদের ১৩ দফা দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। তাদের দাবিগুলো হলো— ১. প্রতি মাসের ৩-৭ তারিখের মধ্যে সব শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন প্রদান করা। ২. সব শ্রমিক ও স্টাফদের বেতন ১৫ শতাংশ বৃদ্ধিসহ ১০০০ টাকা হাজিরা বোনাস। ৩. সব শ্রমিক স্টাফদের বাৎসরিক ১৮ দিনের ছুটির টাকা দিতে হবে। ৪. সার্ভিস বিল দিতে হবে। ৫. টিফিন বিল ৫০ টাকা দিতে হবে। ৬. নাইট বিল ২০০ টাকা দিতে হবে। ৭. আন্দোলনকারী কোনো শ্রমিক কর্মচারীদের চাকরি থেকে বহিষ্কার করা যাবে না। ৮. গর্ভবতী মেয়েদের জন্য চার মাসের ছুটি এবং ছুটির টাকা প্রদান। ৯. শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা যাবে না। ১০. উৎসব জনিত ছুটি ১২ দিনের করতে হবে। ১১. কোনো শ্রমিককে বের হরে দিতে হলে ৩ মাস ১৩ দিনের বেতন দিতে হবে। ১২. শুক্রবার বা কোনো ছুটির দিনে যদি কাজ করানো হয়, তাহলে অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে হবে। ১৩. চাকরির মেয়াদ ৬ মাস হলেই ঈদ বোনাস দিতে হবে।

আন্দোলনরত শ্রমিক আমেনা বেগম বলেন, আমরা কর্মবিরতি দিয়ে কারখানার সামনে বসেছি। আমাদের ১৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কাজে যোগদান করবে না।

আমাদের দাবিগুলো যখনই উপস্থাপন করা হয় তখন কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং চাকরিচ্যুত করে দেন। কোনো ছুটি চাইলে ছুটি পাওয়া যায় না। অসুস্থ হয়ে পড়লে সঠিক চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। গাজীপুর শিল্প পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন বলেন, শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের হেল্প লাইন চালু

শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই) শ্রমবিষয়ক যে কোনো অভিযোগ জানানোর জন্য সার্বক্ষণিক হেল্প লাইন (১৬৩৫৭) চালু রয়েছে। টোল ফ্রি এ সেবা সুবিধায় শ্রমিক অসন্তোষ-সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শ্রম খাতে স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে এক বিজ্ঞপ্তিতে এ সেবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ