ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয় সম্মানের আওতাভুক্ত হোক

প্রকাশনার সময়: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২০

প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। পাকিস্তানি হায়েনার কবল থেকে এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্ত দিতে হয়েছে। তাজা দগদগে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা। পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে এদেশের মুক্তিকামী জনতা দীর্ঘ ৯ মাস প্রাণপণ যুদ্ধের বিনিময়ে পেয়েছে স্বাধীন পতাকা ও মানচিত্র। এ স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিসর্জন দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের ত্যাগে আমাদের অসংখ্য পরিবার মা-বোন, স্বামী-স্ত্রী-সন্তানসহ আপনজন হারিয়েছেন। যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে। মুক্তিকামীদের জীবনের মায়া সেদিন ছিল না, ছিল শুধু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও সহযোগীদের জন্য আমরা কতটা সম্মান দিতে পেরেছি সেটা আজ স্বাধীন দেশের জনমনে প্রশ্ন। এত বড় আত্মত্যাগীদের প্রকৃত সম্মান দিতে কুণ্ঠাবোধ করলে আমরা জাতি হিসেবে তাঁদের কাছে বড় অকৃতজ্ঞ বিবেচিত হবো। তাঁদের ঋণ জাতি হিসেবে আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব না। তবে তাঁদের সম্মান যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রাপ্য হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা নৈতিক দায়িত্ব। আজ মর্মাহত হয়ে বলতে হয় প্রকৃত আত্মত্যাগী বা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই রাষ্ট্রীয় সম্মানের বাইরে। বছরের পর বছর আমরা এ বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মান তথা তালিকার আওতায় আনতে পারিনি। এ লজ্জা আমাদের নতুন প্রজন্মের। এদেশে অনেক দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা, আমলারা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে অবৈধভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বানিয়ে দিব্যি শির উঁচু করে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে এমন দুর্নীতিবাজরা আস্তে আস্তে আইনের কাছে ধরাশায়ী হচ্ছে। জনগণের সম্পদের লুটতরাজের চিত্র সবার সামনে ধীরে ধীরে আসছে। আমরা স্বাধীন দেশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চাই। যখন একটি সরকার দায়িত্ব নেয় তখন দুর্নীতিবাজদের মনিটরিং করার জন্য কোনো সরকারের ব্যক্তিগত উদ্যোগ আজ অবধি দেখা যায়নি। সব সরকারের আমলেই শুনি জনগণকে সামনে রেখে শান্তির বুলি শুনিয়ে গোপনে হরিলুট! এসবের এখন সংস্কারের সময় এসেছে। তরুণ প্রজন্ম এসব সংস্কারে বর্তমানে মরিয়া হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছে। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মের আইকন মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধের সম্মান ও জাতি হিসেবে এতদিন অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নানাভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা তারা নানা কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মানের বাইরে রয়ে গেছেন। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট ও সচেতন মহলে একটা কথা সবচেয়ে বেশি শুনতে পারা যায়; সেটা হলো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে সর্বমহলে নানা বিতর্কও আছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী, ‘১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধার (গেজেটভুক্ত) বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ছয় মাস ছিল, তাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সে হিসেবে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার ন্যূনতম বয়স হবে সাড়ে ৬১ বছর’। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, এ হিসাব ও নিয়মের বাইরেও অনেকে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা বলছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মোট দুই লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জনের নাম বিভিন্ন সময়ে গেজেটভুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা বলছে, গত জানুয়ারি মাসে দুই লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা (মাসিক সম্মানি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে এক লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) সরকার প্রকাশ করেছিল। ফলে দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কত, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। জামুকা সূত্র বলছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মমতাজ উদ্দিনকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি করা হয়। এ কমিটি দুই লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অ-মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে।

অ-মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সব জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে কমিটি করে যাচাই-বাছাই শুরু করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে আরো সাড়ে ১১ হাজার ব্যক্তির নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আর তালিকা থেকে নানা কারণে বাদ পড়েছে প্রায় ২০ হাজার নাম। তবে তালিকায় নতুন নাম অন্তর্ভুক্তি বন্ধ হয়নি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এখনো সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ওঠেনি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে যাননি এমন অনেকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।’ (তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২৩)

দলীয়করণের কারণে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছে; কিন্তু প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ তালিকার বাইরে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বাইরে থাকাটা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য লজ্জাজনক।

কিছুদিন আগে ঘটনাক্রমে আমার সঙ্গে সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের দেখা। ঠিকানা পরিচয় পর্বে জানতে পারি তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা; কিন্তু সরকারি তালিকাতে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নাম-ঠিকানাসহ মুক্তিযুদ্ধের কিছু তথ্য জিজ্ঞেসান্তে তিনি তাঁর নাম-ঠিকানা বিস্তারিত জানান। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বীরভূম বিহার রাজ্যে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন প্রায় মাস খানেক। ট্রেনিং পরবর্তী মা-মাটিকে রক্ষায় দেশে ফিরে যুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল মঞ্জু সাহেবের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেসময় তাঁর নামে ইস্যুকৃত অস্ত্র ছিল— রাইফেল-রাশিয়ান-থ্রি নট থ্রি, আর, এ-৩৭১১৮। যুদ্ধকালীন তাঁর পরিচিত সহ-মুক্তিযোদ্ধা অন্তত ৩৪ জন ছিল।

তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা; কিন্তু তিনি সরকারি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি। তিনি গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা না হলেও কাশিয়ানী টিএনও অফিস কর্তৃক ‘দক্ষিণ ফুকরা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংঘ’-এর দেখাশোনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তালিকাভুক্তির জন্য অনেক অফিস ঘুরেও কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি ৫ জুন, ২০১৪ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তের জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। যার ডিজি নম্বর- ডিজি১১৪৬১৪৫।

তাঁর মনে অনেক কষ্ট যে ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করলাম জীবনবাজি রেখে, প্রায় সব সহ-মুক্তিযোদ্ধা গেজেটভুক্ত হলো; কিন্তু আমি হতে পারলাম না।’ তাঁর মতো এমন অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আজ সরকারি গেজেটের বাইরে। আজ সর্বত্রই দাবি উঠেছে যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পুনরায় প্রকাশ করা হোক।

পরিশেষে বলতে চাই, এ জন্মভূমির স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকার জন্য যাঁরা জীবন দিলেন, জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন তাঁদের সম্মান যেন ভূলুণ্ঠিত না হয়। কোনো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় আর অ-মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আনা না হয়।

আমরা দেশে আর কোনো ধরনের দুর্নীতি-অনিয়ম দেখতে চাই না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব না। মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যূনতম সম্মান প্রদানের প্রয়াসে আবারো নতুন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা শনাক্তকরণে কর্তৃপক্ষের যথাযথ উদ্যোগ, পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।

লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ