মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

জাতীয় সঙ্গীত: আমি কোথায় পাব তারে

প্রকাশনার সময়: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৪

গত ৭ আগস্ট বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এনডিটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হলে তার প্রভাব ভারতের সেভেন সিস্টার্সেও পড়বে। বোঝাই যাচ্ছে সাত বোনের ভাগ্যরেখায় এদিকের এক ভাইয়ের ব্যাপক ভূমিকা আছে।

১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের ‘ওয়ালাইকুমুসসালাম’ বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার, ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না।’

‘দূরদর্শী মওলানা ভাসানী কিংবা ড. ইউনূস যে বাংলা পরগনায় একদিন হুইসেল ব্লোয়ার হবেন এটা তার জমানায় টের পেয়েছিলেন রবি ঠাকুর।

১৯০৫ সালে বাংলার নিখাদ ভূমিপুত্র গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’র সুরে অনুপ্রাণিত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রবি ঠাকুর বাউল ঘরানায় লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গান, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

২০২৪-এ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ঘোষিত দ্বিতীয় স্বাধীনতায় আমাদের অনেকেই সেভেন সিস্টার্সের মানচিত্রে আমাদের দেয়াল রাঙিয়েছি। আমাদের সুরে কথা বলেছেন বাংলাদেশের এ সময়ের লিডার ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাকিস্তান আমলে একই কথা বলে গেছেন বাংলাদেশ আন্দোলনের পুরোধা মুরব্বি মওলানা ভাসানী।

তাহলে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদের কথা বললেই দোষ? আপনারা যা চান সেটিই তো রবি ঠাকুর চেয়েছেন। আপনাদের ন্যারেটিভ আর তাঁর ন্যারেটিভে পার্থক্য তো নেই। আপনারা পশ্চিমবঙ্গ উড়িষ্যা, বিহার পেরিয়ে দিল্লি পদাবনত করার স্বপ্ন দেখেন না? তাহলে ভারতবর্ষের মানুষ হয়ে দুই বাংলার মিলন দেখতে চাওয়াটা রবি ঠাকুরের ভুল কীসে?

আসল সমস্যা এখানে না। রবি ঠাকুরকে আপনারা হিন্দু ঠাওরে ঘৃণার বস্তু বানিয়েছেন। অথচ রবি ঠাকুর নিরাকার ব্রাহ্ম ধর্মের অনুরাগী ছিলেন, যেখান থেকে কালী বা দুর্গাপূজায় আচারিক নিষ্ঠবান হওয়া তাঁর অভিপ্রায় ছিল না। সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল রবি ঠাকুর যে জীবন দেবতার আরাধনা করেছেন সেটি চরম মানবতাবাদকেই মহিমান্বিত করে রেখেছে।

ইতিহাসের ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি কে না জানে? ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছাড়ার পূর্বে সরকারিভাবে পুরো ভারতজুড়ে ছোট ছোট অন্তত ৫৬৫টি দেশীয় রাজ্য গড়ে দিয়েছিল। এই প্রতিটি রাজ্য বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে তাদের নিজ নিজ অবস্থান বজায় রেখে চলছিল। ইংরেজদের গড়া ওই ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতিতে মাত্র পাঁচ হাজার ইংরেজ ৩০ কোটি ভারতীয়কে শাসন করতে পেরেছিল। কারণ ওই নীতির কারণে এ বিপুল জনগোষ্ঠীর ভারতীয়রা ছিল বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত। যে কোনো ঠুনকো অজুহাতেই নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত হয়ে পড়ছিল গণমানুষ। বঙ্গভঙ্গের ফাঁদে পা দেয়া পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গও এর বাইরে ছিল না। অবস্থা বেগতিক দেখে অন্য ফিলানথ্রোপিস্ট কবি সাহিত্যিক ও হিতবাদী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বঙ্গভঙ্গ রদের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন রবি ঠাকুর।

সেসময় দুই বাংলার অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় লিখে ফেলেন অমর সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ এ গানটির মাধ্যমে পূর্ববাংলার প্রতি তিনি অকৃত্রিম প্রেম ও পরম মমত্ববোধই দেখিয়েছিলেন। আর আপনারা কিনা মিনিং দাঁড় করাচ্ছেন পুরোই উল্টো।

কেউ কেউ আরেক কাঠি সরেস। রবি ঠাকুরের গান বাতিলের খাতায় ফেলে রাখতে রীতিমতো লেখকের চরিত্রের ওপর মিথ্যা কালিমা লেপন করছেন। রবি ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পতিতালয় চালাতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন, প্রজা নিপীড়ক ছিলেন, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ দেখিয়েছেন; ইত্যাকার নানা অসত্য অভিযোগে জর্জরিত করেন। অথচ সেদিনের মানুষ রবি ঠাকুরের খুব অথেনটিক জীবনী গ্রন্থ চাইলেই সংগ্রহ করে পাঠ করে নেয়া যায়। রবি ঠাকুরের গান শুনতে না চাওয়া আপনার অধিকার। সেই অধিকারকে জাস্টিফিকেশন দিতে যা নয় তাই বলে কারো চরিত্রের ওপর কালিমা লেপন করাটা ঘোরতর অন্যায়।

২০ শতকের প্রথম দুই দশকে স্বদেশি আন্দোলনের সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল এ গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গবিরোধী পলিটিশিয়ান, স্বদেশি কর্মী ও বিপ্লবীরা বাঙালি জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে এ গান প্রচার করেন।

১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপকধর্মী চিরসবুজ সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’-তে এ গান প্রথম ব্যবহার করেন বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগেও গানটি গাওয়া হয়।

পরবর্তীতে মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এ গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত পরিবেশিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ গান গেয়ে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত হন।

স্বাধীনতার পর দেশের সংবিধানের ৪.১ অনুচ্ছেদে গানটির প্রথম ১০ চরণ জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।

খেয়াল করেন ভাইসব, রবীন্দ্রবিদ্বেষ উগ্রে দেয়ার আলাপ দিয়ে আওয়ামী রেজিমের ফ্যাসিজম তো ভুলে বসছেন না? আপনাদের প্রথম প্রায়োরিটি হওয়া উচিত দেশ পুনর্গঠন ও অন্ধকারে বিলীন হওয়া রাষ্ট্রীয় সিস্টেমের সুসংস্কার। একাত্তরের গণ আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে আমরা যে দেশ পেয়েছি সেই দেশ আওয়ামী লীগ নিজেদের হীন স্বার্থে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। ভেবে দেখুন আপনারা বিপর্যস্ত দেশ জাগিয়ে তুলবেন নাকি মীমাংসিত জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকা নিয়ে অগ্রহণযোগ্য বাজে বয়ানে মনোনিবেশ করবেন?

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার পর খন্দকার মোশতাক সরকার এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সরকার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের প্রস্তাবনা আনেন। সেসব প্রস্তাবনা কার্যকরী হয়নি। ২০০১-এ আসা বিএনপি সরকারের দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে লিখিত প্রস্তাবনা আনেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ওই প্রস্তাবনা বিবেচনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ফাইনালি সে প্রস্তাবনাও টেকেনি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এবার আরেকবার জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের আলাপ উঠছে।

একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ড বিশ্ব মানচিত্রে গৌরবময় জায়গা করে নিয়েছে। মহান মুক্তিযোদ্ধারাই ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি তাদের স্বপ্নের স্বাধীন দেশের ন্যাশনাল অ্যান্থেম বলে মান্যতা দিয়েছে। কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও তারা প্রতিবাদের স্বরূপ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এখন আমরা যদি মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করতে চাই, সেটি আমরা পারব না এমনটা নয়। কিন্তু নিজেদের গৌরবময় অতীতকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিতে চাইলেই কি তা মুছে ফেলা সম্ভব হবে? শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বীর ও বীরাঙ্গনা যারা জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানের আধিপত্য, জুলুম ও চরম বৈষম্য রুখে দিয়ে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক দেশটি এনে দিয়েছেন তাদের মতামতকে পাশ কাটানো বা অগ্রাহ্য করার প্রাধিকার আসলে কাদের? নতুন জাতীয় সঙ্গীত? আমরা কোথায় পাব তারে? বাউল গগন হরকরারা কি সব খানে সব কালে জন্মান?

লেখক: সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ