প্লাস্টিক দূষণ আর অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। মহামূল্যবান প্রবালসহ অস্তিত্ব হারিয়ে হুমকির মুখে প্রাণী। অপরদিকে বর্তমানে বিশ্বের একটি বড় সমস্যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি। এ উষ্ণতা বাড়ার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে যা বাস্তুসংস্থানের জীবন ধারণের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধু যে মানুষের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে তা না, এটি সামুদ্রিক প্রাণীদের একটি বড় অংশের জীবননাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের করা কিছু গবেষণায় এ বিষয়টির সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। কম সময়ের মধ্যে একাধিকবার সমুদ্রের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে তা এক সময় ব্যাপক ধ্বংস ডেকে আনতে পারে। ২১ শতকের শুরুর দিকে মানবসৃষ্ট কারণে বৈশ্বিক জলবায়ু বাড়তে থাকলে এ সমস্যা আরো তীব্রতর হতে থাকে। তাছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বের সাগর ও মহাসাগরগুলোর পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
অপরদিকে গাছপালার মতো সমুদ্রও পরিবেশ থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে পরিবেশকে শীতল রাখতে ভূমিকা রাখে। সমুদ্রের ঢেউ কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে তা অতল গভীরে ম্লান করে দেয়। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমুদ্রের তাপ বাড়িয়ে তুলেছে কয়েকগুণ। ফলে সমুদ্রে বাস করা প্রাণীরা অকালে মারা যাচ্ছে। প্রাণীদের অস্বাভাবিক এ মৃত্যুতে সমুদ্র যেন এখন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিচ্ছে। জীবন-জীবিকার জন্য পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। জীবনধারণের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেনের প্রায় ৫০ শতাংশ তৈরি করে সমুদ্র। আর মানুষের সৃষ্টি করা ৩০ শতাংশ কার্বন -ডাই-অক্সাইড শোষণ করে সাগর-মহাসাগরগুলো। গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়। যার অর্ধেক দিয়ে বানানো হয় শপিং ব্যাগ, কাপ ও প্যাকেজিং পণ্য। আর প্রতি বছর এসব প্লাস্টিকের ৮ থেকে ১০ লাখ টন ফেলা হয় সমুদ্রে। যদি এসব প্লাস্টিক এক জায়গায় বিছিয়ে রাখা হয় তবে এটি ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ঢেকে ফেলার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ এ প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে যাবে কাতার, জ্যামাইকা কিংবা বাহামার মতো ছোট দেশগুলো। এ হার অব্যাহত থাকলে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে সাগরে ৫ লাখ ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে প্লাস্টিক বর্জ্য। যা ফ্রান্স, থাইল্যান্ড বা ইউক্রেনের চেয়েও আকারে বড়।
গবেষকদের মতে, বর্তমানে সাগরে ভাসমান কিংবা তলদেশে আছে প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরা। যা সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সাইন্স অ্যাডভান্স রিসার্চ’ জানিয়েছে, মহাসাগরে যত প্লাস্টিক বর্জ্য আছে তার ৮০ শতাংশই এসেছে এশিয়া থেকে। সমুদ্রে বর্জ্য ফেলায় সবার চেয়ে এগিয়ে ফিলিপিন্স। এ তালিকায় আরো আছে ভারত, মালয়েশিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার নাম। বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক বর্জ্যের সবশেষ ঠিকানায় পরিণত হয়েছে মহাসাগরগুলো। সমুদ্রের তলদেশ যেন ময়লার বিশাল ভাগাড়। এর প্রভাবে প্রতি বছরই যেমন বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা, বাড়ছে সমুদ্রের পানির উষ্ণতা। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মানুষকে সচেতন করতে নানা প্রতিপাদ্য নিয়ে ১৯৯২ সাল থেকে ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস।
প্লাস্টিক কীভাবে সমুদ্রে প্রবেশ করে?
সব সামুদ্রিক দূষণের ৮০ শতাংশই ঘটে প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে। সমুদ্রে নির্গত হওয়া বেশির ভাগ প্লাস্টিক অনুপযুক্ত বর্জ্য নিষ্পত্তি ব্যবস্থার দলে নদী-নালা দিয়ে স্রোতের সঙ্গে আসে। মাছ ধরার জাল এবং সমুদ্রে চালিত অন্যান্য যানের প্লাস্টিকও ফেলে দেয়া হয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ এবং কন্টেইনার ছাড়াও মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত ক্ষুদ্র কণাগুলোও সমুদ্রে প্রবেশ করে। মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলোর দৈর্ঘ্য ৮ মিলিমিটারেরও কম। মাছ ও সামুদ্রিক নানা প্রাণী এগুলো খেয়ে ফেলে, যা প্রাণী এবং মানুষ উভয়েরই ক্ষতির কারণ হতে পারে।
আনুমানিক ৫০ ট্রিলিয়ন থেকে ৭৫ ট্রিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিকের টুকরা বর্তমানে সমুদ্রে রয়েছে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা খুব কমই আছে। কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দিয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক লিভার, কিডনি ও অন্ত্রের মতো অঙ্গগুলোতে জমা হতে পারে।
উদ্বেগ রয়েছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো সম্ভাব্যভাবে প্রদাহ, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং সেলুলার ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিজ্ঞান লেখক এরিকা সিরিনো বলছেন, সমুদ্রে বসবাসকারী প্রাণীরা ক্ষুদ্র কণাগুলো (মাইক্রোপ্লাস্টিক) প্রচুর পরিমাণে খায়। প্লাস্টিকের টুকরাগুলোতে বিষাক্ত রাসায়নিক রয়েছে। এ রাসায়নিকগুলো ইতোমধ্যে মানব হরমোন এবং প্রাণী হরমোনগুলোতে প্রভাব ফেলছে। এগুলো শরীরে বিষাক্ত পদার্থ জমার কারণ হতে পারে, যা সময়ে সঙ্গে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
সমুদ্রে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিকের উৎস কোন দেশ?
সায়েন্স অ্যাডভান্সেস রিসার্চের প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে, সমুদ্রে পাওয়া সব প্লাস্টিকের ৮০ শতাংশ আসে এশিয়া থেকে। মহাসাগরে সব প্লাস্টিক বর্জ্যের এক তৃতীয়াংশের বেশি (৩৬.৪ শতাংশ) ফিলিপাইন থেকে আসে বলে বলে মনে করা হয়। তালিকায় এরপরই আছে ভারত (১২.৯ শতাংশ), মালয়েশিয়া (৭.৫ শতাংশ), চীন (২.৭ শতাংশ) এবং ইন্দোনেশিয়া (৫.৮ শতাংশ)। এ পরিমাণগুলোতে বিদেশে রপ্তানি করা বর্জ্য অন্তর্ভুক্ত নয়, যা সমুদ্রে প্রবেশের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকতে পারে।
প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য এত বিপজ্জনক কেন?
প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো, এগুলো সহজেই বায়বীয় হয় না। ফলে এগুলো শত শত বছর ধরে পরিবেশে টিকে থাকতে পারে এবং মারাত্মক দূষণ সমস্যা সৃষ্টি করে। সমুদ্রে নির্গত প্লাস্টিকগুলো দীর্ঘ সময়ের জন্য ভাসমান থাকে। অবশেষে এগুলো তলদেশে ডুবে যায়। মহাসগরে যত প্লাস্টিক, এর ৯৯ শতাংশই ভূপৃষ্ঠের নিচে মাইক্রোপ্লাস্টিক আকার ধারণ করে আছে।
এদিকে ২০২১ সালের ৫ মে ন্যাচার ম্যাগাজিন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সমুদ্রের তাপবৃদ্ধি নিয়ে, যেখানে মূল লাইনটি ছিল, ‘হঠাৎ করে সামুদ্রিক পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা বাস্তুসংস্থানকে ওলট-পালট করে দিতে পারে। কখন এমন ভয়াবহ অবস্থা ঘনিয়ে আসবে তার পূর্বাভাস দিতে তড়িঘড়ি করে কাজ করছেন বিজ্ঞানীরা।’ ওই একই প্রবন্ধে তুলে ধরা হয় ১০ বছর আগের সময়ের কথা, যখন অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রের তীরে মাছ মরে ভেসে আসতে শুরু করল, বিজ্ঞানীরা তখন প্রথম সামুদ্রিক তাপমাত্রা বাড়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু করেন।
পৃথিবী নামক এই গ্রহের তাপমাত্রা দিনকে দিন যেন বেড়েই চলেছে, যা পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন প্রমাণই মিলছে, সমুদ্রের তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্যই সামুদ্রিক প্রাণীরা এমন ভয়াবহ ঘটনার শিকার হচ্ছে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সমুদ্রের তাপও।
ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) এর তথ্য অনুযায়ী পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২১ সালের জুলাইতে সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর স্যাটেলাইট সিস্টেম বলছে, গত সাত বছরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত।
প্রকৃতি থেকে অত্যধিক পরিমাণ কার্বন শোষণ ও বায়ুমণ্ডলের ৯০ ভাগ তাপ শুষে নেওয়ার কারণে সমুদ্রের তাপ বেড়ে যাওয়ায় সেখানে বাস করা প্রাণীরা এখন হুমকির মুখে। শুধু ২০২১ সালেই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কলাম্বিয়া উপকূলে ১০০ কোটি সামুদ্রিক প্রাণী মারা গেছে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে, উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত দেশগুলো এক সময় মৎস্যসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল, এখন তা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ (বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল সিস্টেম) নব্বইয়ের দশক থেকে এই পর্যন্ত ৫ বার ভয়াবহতার মুখে পরেছে। ১৯০০ সালের পর এই প্রথম ২০২০ সালে সমুদ্রের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থার (আইপিসিসি) মতে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে।
সমুদ্র নিয়ে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৮৭০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বের সমুদ্রতলের তাপমাত্রা বেড়েছে ৫৭ ভাগ তাপ। যার মধ্যে ২০১৪ সালেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ ভাগের বেশি। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে এটি এক সময় সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে।
২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ‘আইপিসিসি’ প্রস্তাব করেছিল তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ধরে রাখতে। কিন্তু ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই আমাদের বাস্তুসংস্থান পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়েছে।
তাই উন্নত রাষ্ট্র ও বিশ্ব নেতাদের এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকে ঠেকাতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের তাপমাত্রা আরও ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে। যা সমুদ্রে থাকা সব প্রাণীর প্রাণ কেড়ে নিয়ে এক সময় এদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ