মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

‘ইন্ধনে’ লম্বা হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ

প্রকাশনার সময়: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬

পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ বাড়ছে। সরকারকে বিপদে ফেলতে বহিরাগতদের ‘ইন্ধনে’ লম্বা হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। গতকাল বুধবারও বকেয়া বেতনের দাবি, চাকরি স্থায়ীকরণ, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, নারী শ্রমিকের সমান সংখ্যক পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছে। তাদের বিক্ষোভের মুখে গতকাল শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় অন্তত ৭০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এসব ঘটনায় সেনাবাহিনীর সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এর আগের দিন গত মঙ্গলবার আশুলিয়ায় ৪০টি ও গাজীপুরে ৪৫টি কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।

জানা গেছে, বুধবার সকালে আশুলিয়ার বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো এলাকা পর্যন্ত অবস্থিত বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করলেও কাজ না করে বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ একে একে কারখানাগুলো ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কারখানায় ছুটি ঘোষণার পর শ্রমিকরা বাইরে বেরিয়ে এসে অন্যান্য কারখানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। পরবর্তীতে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে, সেসব কারখানা কর্তৃপক্ষও কারখানায় ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই অঞ্চলের অন্তত ৬০টি ছোট-বড় পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণার তথ্য পাওয়া গেছে। শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে বন্ধ হয়ে যায় নবীনগর-চন্দ্রা এবং বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়ক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে শিল্প পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা।

শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিক্ষোভের মুখে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকা পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে অন্তত ৬০টি কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানা ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সকাল ৮টার পর এই ঝামেলা শুরু হওয়ার পরে একে একে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলো ছুটি দিয়ে দেয়। শ্রমিকরা এখনো সড়কে রয়েছেন, আমরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

আশুলিয়া ছাড়াও বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুরের শ্রীপুর, রাজেন্দ্রপুর, ভোগড়া বাইপাসসহ বেশ কিছু এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা। এতে ওই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুই বছরের বকেয়া, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) পরিশোধের দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন শ্রীপুর উপজেলার নয়নপুর এলাকার আরএকে সিরামিক কারখানার শত শত শ্রমিক। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় দুপাশে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজট। ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন পরিবহনের হাজারো যাত্রী। এরইমধ্যে ঘটনাস্থলে শিল্প পুলিশের সদস্যরা উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।

আরএকে সিরামিক কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকরা বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে না। দুই বছরের বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বকেয়া রেখেছে। দেই-দিচ্ছে করে শুধু সময় পার করছে। এসব দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কথা বলতে গেলে আমাদের অনেক গালাগাল খেতে হয়। অনেকে আবার চাকরিচ্যুত হয়।

আরএকে সিরামিক কারখানার মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, শ্রমিকদের বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধির জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হচ্ছে। কিন্তু কারখানার শ্রমিকদের দাবি, বুধবারের মধ্যে বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট বকেয়া পাওনা পরিশোধ করতে হবে। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন।

শ্রীপুর থানার ওসি এসএম সোহেল রানা বলেন, সকালে বকেয়া পরিশোধের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শ্রমিকেরা। বিষয়টি নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে নেয়ার চার ঘণ্টা পর বর্তমানে সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

এদিকে, ১৮ দফা দাবিতে সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকায় হেলথ কেয়ার ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেড কারখানার বিক্ষোভ করছেন শ্রমিকরা। সকাল ৯টা থেকে কয়েকজন কর্মকর্তার পদত্যাগ নিশ্চিত করা, শ্রমিক ইউনিয়ন বাস্তবায়ন, বাৎসরিক বেতন সর্বনিম্ন ৩০০০ টাকা বাড়ানো, আন্দোলনরত কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত ও হয়রানি না করা, ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ২০ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা।

এদিকে কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় ট্রান্সকম বেভারেজে ২০ দফা দাবিতে গত মঙ্গলবার থেকে আন্দোলন করে আসছিল শ্রমিকরা। গতকাল সকালেও তারা ভারতীয় কর্মকর্তাদের অপসারণ, দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে নিয়োগকৃত শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ীকরণ, ৫ তারিখে মধ্যে বেতন প্রদান, নারী শ্রমিকদের নৈশকালীন ডিউটি বাতিলসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়েছেন।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের-২ শ্রীপুর ক্যাম্পের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আজিজুল হক বলেন, বুধবার সকাল থেকেই কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা আন্দোলন করছিল। পরে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে শ্রমিকরা মহাসড়ক ছেড়ে চলে যান। শ্রমিক অসন্তোষের পরিস্থিতি কতদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে প্রশ্নে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে আজকে (গতকাল) থেকে অ্যাকশন শুরু হবে। সেখানে ক্ষতি হয় এমন কোনো অ্যাকশন পুলিশ নেবে না। রাস্তাগুলো খালি করার জন্য যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে। যারা ইন্ধন দিচ্ছে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। একইসঙ্গে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে আলোচনা করা হবে। আমি তো একদিনে বসে শ্রম আইন ঠিক করে দিতে পারব না।

আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে যে তথ্য রয়েছে, সেটার ভিত্তিতে তাদেরকে (ইন্ধনদাতাদের) গ্রেপ্তার করা হবে। সেখানে যে জনদুর্ভোগ তৈরি হয়েছে, সেটার জন্য পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

তিনি বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে আমরা মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে একাধিক সভা করেছি। আমাদের শিল্প উপদেষ্টা তিনিও কথা বলছেন। সব শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে আমরা এটাই জানতে পেরেছি, এখন যে আন্দোলনগুলো হচ্ছে, শ্রমিক নেতারা এই আন্দোলনের প্রকৃতিটা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি উঠে আসছে না। কোনো নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না।

উপদেষ্টা বলেন, যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলনগুলো করে থাকেন, তারাও সেখানে সেভাবে সক্রিয় নেই। বহিরাগত লোকজনের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছেন, এজন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছেন। সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করছি, সেগুলোর জন্য সরকার সফ্ট লোন ঘোষণা দিয়েছে। সেটার পরিধি আরও বৃদ্ধি করা হবে। আসিফ মাহমুদ বলেন, তবে এই ছোট ছোট কয়েকটি সুনির্দিষ্ট জায়গার অসন্তোষকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ফ্যাক্টরি ক্লাস্টার আছে, সেখানে দেখা গেছে বহিরাগতরা এসেছে এবং বেকার যুব সংঘ নামে যারা কখনো শ্রম এ রিয়ার মধ্যে আন্দোলন করেনি, এমন সব জায়গায় গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, শ্রমিক নেতারাই আমাকে বললেন যে, তারা সেখানে হেঁটে এসেছেন এবং তারা দেখেছেন যে হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা টোকাই, বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য টাকা দিয়ে যাদের ভাড়া করা হয়, তাদেরকে সেখানে দেখা গেছে। সাভারের আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষে জড়িত বেশিরভাগই বহিরাগত বলে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ বলেন, ‘চারদিকে যে শ্রমিক অসন্তোষ হচ্ছে, তা নিয়ে আজ (বুধবার) আমরা বৈঠক করেছি। আমরা খবর পাচ্ছি যে প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবেন না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছে। শ্রমিকদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনারা (শ্রমিকরা) বাধা দেন, আপনারা বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। এমনভাবে তারা মিশে আছে যে, তাদের আলাদা করা ডিফিকাল্ট (কঠিন) হয়ে যাচ্ছে।’

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘প্রকৃত শ্রমিকরা এ ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। যেখানে তার জীবিকা, সেখানে সে (শ্রমিক) ধ্বংস করবে না। আপনারা খেয়াল করে থাকবেন, যেগুলো ভাইব্রেন্ট (গুরুত্বপূর্ণ) কারখানা, কুমিল্লায় প্রাণ কোম্পানির কারখানা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রাণ কোম্পানিতে কোনোদিন শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। কিন্তু এই কোম্পানি যেহেতু দিনকে দিন বিশ্ব ছেয়ে ফেলছে, তাহলে এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে এ খাতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বন্ধ হয়ে যাবে।’

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ