মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

শিক্ষকদের যারা অপমান করলেন এবং করালেন

প্রকাশনার সময়: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:১৭

আমাদের দেশে শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর সম্পর্ক অনেক আগেই নিম্নমুখী হয়েছে। সমাজ পরিবর্তন না হলে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব না। এর পেছনে রয়েছে সামাজিক একাধিক কারণ এবং শিক্ষকদের নিজেদের দায়। আবার যদি বলি শিক্ষকদের অপমান করাটা সম্ভবত সবচেয়ে সহজ। এদেশে শিক্ষকদের কেবল বইয়ের পাতায় মা-বাবার পরের স্থানটি দেয়া হয়েছে, বাস্তবে ভিন্ন। শিক্ষকরা অভিভাবকের চড় থাপ্পড় খেয়েছেন, শিক্ষার্থীর হাতে মার খেয়েছেন, কমিটির সদস্যদের দ্বারা শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হয়েছেন। এ রকম বহু ঘটনা রয়েছে যেখানে শিক্ষকরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মানসিক চাপ আর নির্যাতনের কথা এর ভিতর আনতে চাই না। উদাহরণ দিলে চুয়াডাঙ্গার ভিক্টোরিয়া জুবিলি (ভি.জে) সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসির নির্বাচনি পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষককে চড়-থাপ্পড় মারার ঘটনাটা বলতে পারি। আবার এই যে গত কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভিডিওতে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অত্যন্ত অপমানজনকভাবে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা। এসব কিন্তু করছে সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই। শিক্ষকদের পক্ষে বেশির ভাগই মতামত দিচ্ছেন।

আবার বিপক্ষেও বলছেন অনেকে! এমনকি বলছেন এটা নাকি সেই শিক্ষকের পাপের কারণ! আমি বলছি, না। শিক্ষকরা অন্যায় করেননি। একজন মানুষ হিসেবে কিছু ভুল শিক্ষকরাও করেছেন এবং করেন। আমি ধরেই নিচ্ছি যার যার সঙ্গে এমনটা করা হয়েছে তারা সবাই দোষী। তা হলেও কি এ ব্যবহার কোনো ছাত্র বা ছাত্রী তার শিক্ষকের সঙ্গে করতে পারে? প্রশ্ন এ সমাজের কাছে। এ সভ্যতার কাছে। কোথাও আমরা সভ্যতাকে নগ্ন করলাম না তো? যারা পেছন থেকে এটাকে সহায়তা বা সমর্থন করেছেন তারাও কি নিজেদের দায় অস্বীকার করতে পারেন? সত্যি বলতে শিক্ষকদের মধ্যেও রয়েছে দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। নানা অনিয়মের সঙ্গে তারা জড়িত হয়েছেন। তার এ অপরাধের তো বিচারের একটি প্রক্রিয়া ছিল যার আইনি ভিত্তি রয়েছে। নিজেকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া যেত। আবার তাকে একটা সুযোগও দেয়া যেত। সব মিলিয়ে তিনি একজন শিক্ষক। আমার শিক্ষক যত বড়ই অপরাধী হোন না কেন, আমি কিন্তু নিজে তাকে কোনোদিনই অপমান করতে পারব না।

তিনি যদি কোনো জঘন্যতম অপরাধীও হন আমি তাকে ঘৃণা করতে পারব তবে নিজ হাতে বা নিজে উপস্থিত থেকে তাকে টানা হেঁচড়া করতে পারব না। আমার হাত কাঁপবে। হতে পারে আমি সাহসী নই। আর হতেও চাই না। তিনি আমাকে অন্তত এক দিনের জন্য হলেও শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমার শিক্ষক। এখন প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষকের অপরাধের ফিরিস্তি লম্বা হওয়ার পেছনে কি সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা দায়ী থাকে না? বেসরকারি শিক্ষকদের রাজনীতি করার সুযোগ থাকার প্রকৃতপক্ষে কি দরকার আমার বোধগম্য নয়। একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও হতে দেখেছি। তাহলে তিনি স্কুল এবং ইউনিয়ন কিভাবে সামলাবেন? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা-সেমিনারে শিক্ষককে যেতে হবে কেন? মোট কথা, শিক্ষক কেন রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন? সেই প্রশ্ন কি দেশের রাজনীতিবিদরা করেছেন? এ ছাড়াও জবাবদিহির যে জায়গা সেখানে যদি হাত দেন, তাহলে দেখবেন একজন প্রধান শিক্ষক কিন্তু একা কোনো অনৈতিক কাজে দায়ী থাকেন না। যাই হোক, আমরা দেখছি শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য হতে। মায়ের মতো একজন শিক্ষিকাকে কিভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে ফেসবুকের কল্যাণে আমরা দেখেছি। তাতে মর্মাহত হয়েছি। এই যে অভিভাবকগণ যারা এসব ছাত্রছাত্রীর এ ধরনের কাজকে কোনোভাবে সমর্থন দিলেন তারা মনে করবেন না এ বিষয়ে কেবল একজন শিক্ষকের বিদায় হলো, মনে রাখবেন একদিন এ সমাজটাও এভাবে নষ্ট হবে। তার পথ সুগমে সাহায্য করছেন মাত্র। আমি আবারো বলছি শিক্ষকরাও অন্যায় করেন। কিন্তু তার শাস্তি প্রক্রিয়াটি কি এভাবে হওয়া ঠিক হলো? এই শিক্ষক কি এক দিনের জন্যও এ ছেলেমেয়েদের নিজের সন্তানের মতো দেখেননি? অবশ্যই দেখেছেন। একজন শিক্ষক মানেই একজন অভিভাবক। তার চোখের জল হয়তো কেউ গুরুত্ব দেননি কিন্তু সেই জলই এক দিন না ধ্বংসের কারণ হয়। শিক্ষকের গাল আছে থাপ্পড় দেয়ার জন্য, সমাজেরও কি গাল আছে? এ থাপ্পড় কি সমাজেরও গালেও লাগেনি? এত শিক্ষার ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে নৈতিক শিক্ষার অভাবে আজ সমাজ নিচের দিকে ধাবমান। কেউ দেখছে আবার কেউ দেখছে না। যারা দেখছে তারাও চুপচাপ বসে আছেন। কারণ কিছুই করার নেই।

এখন শিক্ষককে চড় দেয়া যায়, শিক্ষককে পেটানো যায়, জোর করে পদত্যাগ করানো যায় এবং আরো নানাভাবে হয়রানি করা যায়! কারণ তাদেরও রক্তমাংসের শরীর এবং প্রায় শান্ত স্বভাবের মানুষ। চাইলেও তারা উগ্রভাবে প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ তারা শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবীর সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এ পেশায় আসতে হয়। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা এলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটাই শিক্ষকতা। অনেকদিন আগের কথা মনে আছে? ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই ঘটনাটিকে নৈতিক অধঃপতনসহ আরো নানাভাবে ধিক্কার জানায়। ধিক্কারের মতোই একটি ঘটনা এটি। আমিও ধিক্কার জানাই। কিন্তু এ ঘটনা কেন ঘটল বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এ মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ওই অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখিনি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়েছে। যত সম্পর্ক ঢিলা হয়েছে তত শ্রদ্ধা, ভক্তি কমেছে। সেই বাদশাহ আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। একজন শিক্ষকের যে তার সন্তানতুল্য ছাত্রকে শাসন করার অধিকার আছে সেই বোধটাই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। আর এখানেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক এবং গত ১৫ বছর ধরেই ছাত্রছাত্রী পড়ানোর কাজটি করেছি। শিক্ষা দিতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে ভালো হতে পারিনি। হওয়ার চেষ্টাও করিনি। সেটা সম্ভবও নয়।

শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তবে ছাত্রের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা আরো বেশি দুঃখজনক, ন্যক্কারজনক এবং মানসিক কষ্টের। আমি একজন শিক্ষক এবং আমার সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে যেতাম কি না সন্দেহ। এ ধরনের কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্ছিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল এ সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে তা নয়।

অনেক আগে থেকেই এ নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। যার ফলে আজ একজন শিক্ষককে কোনো অপরাধ ছাড়াই ছাত্রের হাতে প্রাণ দিতে হলো। আমরা যদি এখনো ঘুরে না দাঁড়াই তাহলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীকে শাসন করতে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ শাসন মানেই সেই ছাত্রের বিরাগভাজন হতে হবে। আবার শুধু ছাত্রছাত্রী কেন অনেক অবিবেচক অভিভাবককেও দেখেছি তুচ্ছ কোনো কারণে তার সন্তানের হয়ে শিক্ষককে অপমান করতে ছাড়েন না। এক্ষেত্রে সেই ছাত্র আরো বেশি সাহস পায়। অবশ্য ছাত্রকে শাসন করা যদি অপরাধের ভিতর পরে তো অন্য কথা! একসময় মানে আমাদের সময় বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বলে আসত- আমার সন্তানকে রেখে গেলাম। ওকে পড়ানোর প্রয়োজনে যা শাসনের দরকার হয় করবেন। এখন ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করা নিষেধ। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকরা বেত নিয়েই ক্লাসে যেতেন। পড়া না হওয়ার জন্য, দুষ্টুমির জন্য বেতের বাড়ি খেতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না বা এখনো নেই। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করে দেশকে কিছু দেয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকতায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে থাকবে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময় আমাদের আরো খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ