মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াতে টানাপড়েন

প্রকাশনার সময়: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:০০

নির্বাচন ইস্যুতে দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে ফের টানাপড়েন চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, ওই ভাষণ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। মাঝখানে কিছুটা কাছাকাছি এলেও নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে দূরত্ব আবারও বেড়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে দুই দলের মধ্যে মতের মিল থাকলেও জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে দুই মেরুতে অবস্থান করছে বিএনপি-জামায়াত।

বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চাইলেও জামায়াতের অবস্থান ভিন্ন। জামায়াত দ্রুত নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো না করে সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চায়। জামায়াত নেতারা বলছেন, তারা চান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার শুরু করুক এবং নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিক। তারা অতিদ্রুত নির্বাচন চায় না। তবে নির্বাচন আয়োজনে সরকার দেরি করুক তাও চান না বলে জানান জামায়াত নেতারা।

এদিকে গত রোববার কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, নির্বাচনের ব্যাপারে যে যৌক্তিক সময়ের কথা বলা হয়েছে খুব শিগগিরই সেই সময়টি নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট দেশের দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপির পক্ষ থেকে এই সরকারকে স্বাগত জানানো হলেও গত ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ না থাকায় গত ২৬ আগস্ট বিএনপির পক্ষ থেকে এক ধরনের আক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে। তা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করে মির্জা ফখরুল বলেন, তাদের প্রত্যাশা ছিল ড. ইউনূস নির্বাচন নিয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, সে প্রসঙ্গে সেদিন তিনি মন্তব্য করেন, ‘অল্প কিছু মানুষের সংস্কারে তিনি বিশ্বাস করেন না।’ অন্যদিকে জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার ভাষণকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। সরকারকে সময় দিতে চায় দলটি।

‘কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়’— জাতির উদ্দেশে ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘এখনো একটা জিনিস ধোঁয়াশা, যেটা আমার পরিষ্কার হয়নি। যেটা আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা একটা রোডম্যাপ দেবেন, গণতন্ত্রের পথে কীভাবে যাবেন, কিন্তু আমরা পাইনি। সংস্কারের কথা বলেছেন, কিন্তু কোন কোন খাতে সংস্কার আনবেন, সে ব্যাপারে কিছু আভাস দিয়েছেন। আমি জানি, এত অল্প সময়ে সেটা সম্ভব নয়। তারপরও একটা ধারণা দিলে ধারণা করতে পারতাম যে ভালোর দিকে যাচ্ছে।’

ফখরুল ছাড়াও দেশকে আবার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফেরাতে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমদ। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার যমুনায় আলোচনার জন্য প্রধান উপদেষ্টার ডাক পান বিএনপি নেতারা। সেখানে সোয়া এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, তাদের মধ্যে অত্যন্ত ‘ফলপ্রসূ’ আলোচনা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের উদ্যোগ নিয়েছে ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার। এরপর শনিবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মতবিনিময় করেন ড. ইউনূস।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সমমনা দল ও জোট নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করেছে বিএনপি। সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিয়মিতই জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল দলটির। এবারো ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় দুই দলের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে এক ধরনের টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। আবার জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করতে চাইলেও এ নিয়ে জামায়াত বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ অনেকটা সীমিত হয়ে আসছে বলেও ধারণা দিয়েছেন অনেকে।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থান প্রসঙ্গে সহযোগী একটি দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বিএনপি নির্বাচনের জন্য তোড়জোড় করছে। আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিচ্ছি না। এ সময় জাতির ক্রাইসিস চলছে। বিভিন্ন জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এটাকে আমরা এই মুহূর্তের রাজনীতি হিসেবে নিয়েছি। আমরা মনে করি, এ বিষয়গুলো সমাধান না করে নির্বাচনের কথা তোলা যৌক্তিক নয়। তাই আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি না। মানুষের এ বিষয়গুলো সমাধান করার জন্য আল্লাহ আমাদের যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছেন সেটুকু চেষ্টা করে যাব।

গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, বাংলাদেশের সংস্কার করেন, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতি করে সংবিধান, বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে যেন না দিতে পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কাছে টাকা আছে, অস্ত্র আছে। তারা দুর্নীতিবাজ। তাদের কাছে সবচেয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র আছে, তাদের ধরে আনতে হবে। এই অস্ত্র যদি উদ্ধার করে আনতে না পারেন, তাহলে বাংলাদেশে আপনাদের পক্ষে নির্বাচন করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে।

জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থানের সমালোচনা করে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গত শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশে বলেন, কেউ কেউ বলছেন বন্যায় ভাসছি, আবার এখন নির্বাচনের দরকার কী? যারা যেমন, তারা তেমনই কথা বলবেন। কিছু মানুষ আছে, কিছু দল আছে আমাদের সঙ্গে থাকলেও ১৯টা সিট পায়, আমাদের থেকে বেরিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে ৩টা সিট পায়, তারা তো ভোটকে ভয় পাবেই। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ২৯ আগস্ট একটি দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমরা এই মুহূর্তে আমরা আর জোটবদ্ধ নাই। আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এটা এখন কোনো কাজ করে না।’

এর একদিন পর গত শুক্রবার নরসিংদী শিশু একাডেমি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেলারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বাস্তবে কোনো দলীয় জোট নেই। তিনি আরও বলেন, গত আন্দোলনে বিএনপি থেকে জোট না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন তাদের দলীয় নেতারা। তাই তাদের সঙ্গে এখন আমাদের কোনো দলীয় জোট নেই। তবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় আছে, থাকবে এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, এটা দল রক্ষা করে চলব। তাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে বসা হয় এবং দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক দীর্ঘ সময়ের। এক সঙ্গে জোট বেঁধে আন্দোলন ও নির্বাচন সবই তারা করেছে। বিএনপি ও জামায়াত জোট একবার সরকারও গঠন করেছে। সেই সরকারে জামায়াতের নেতারা মন্ত্রীও হয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা এখন দুই ভুবনের বাসিন্দা হতে চলছে। ইতোমধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ