আমি পরিবর্তনের পক্ষে। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় দার্শনিক পল এস বার্ক বলতেন, চেন্জ চেন্জ চেন্জ ইস লাইফ। জীবন পরিবর্তনশীল। আমরা যারা মধ্য ষাটে, আমরা কত যে পরিবর্তন মেনে নিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই। আমাদের পিতারা ৪৭’র অন্যায্য দেশভাগ মেনে নিয়েছিলেন। আমরা একাত্তরে যৌক্তিক মুক্তিযুদ্ধ মেনে নিয়েছি। আমরা পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন ও মিলিটারি শাসন মেনেছি। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এরশাদের পতন মেনেছি। মুক্তিযুদ্ধ মানা না মানার সহাবস্থান মেনেছি। অতিসম্প্রতি জাঁকিয়ে বসা শেখ হাসিনার পলায়ন, দেশত্যাগও মেনেছি। কারণ রাজনীতি হচ্ছে মানা না মানার একটা সমীকরণ।
আজকে বাংলাদেশে তারুণ্যের যে জোয়ার তার সঙ্গে দুনিয়ার অনেক দেশের জোয়ারের মিল আছে। যারা ভুলে গিয়েছিল এটি ডিজিটাল দুনিয়া, যাদের কথা শুনলে মানুষ মনে করত কাউয়া কা কা করছে তারা তারুণ্যের ভাষা বুঝতে পারেননি। ফলে পরিবর্তন দরকার হয়ে পড়েছিল। কথায় বলে হামবড়া ভাব পতনের মূল। অহংকার যে কত রাজা বাদশার গদি কেড়ে নিয়েছে তার প্রমাণ ইতিহাস। খোদ আমেরিকা হারানো ইংল্যান্ডের মনে ছিল না যে মানুষ বিদ্রোহপ্রিয়।
জর্জ ওয়াশিংটন নামের এক সেনাপতির কাছে যে মার খেয়ে আমেরিকাকে স্বাধীনতা দিতে হবে এটা তারা ভাবতেও পারেনি। কিন্তু সেটাই ঘটেছিল। ১৭৭৬ সালের ২২ আগস্ট নিউইয়র্কের এক যুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে আমেরিকানরা পরাজিত হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা নিউইয়র্ক দখল করে শুরু করে অত্যাচার আর লুটতরাজ। ওই সময় তারা ঘোষণা করল যে, যেসব বিদ্রোহী ষাট দিনের মধ্যে অস্ত্র পরিত্যাগ করবে, তাদের ক্ষমা করা হবে।
এ রকম চরম হতাশার মধ্যে আমেরিকানদের কাছে একমাত্র আশার প্রদীপ ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর অধীনস্থ স্বাধীনতাকামী আমেরিকান সৈন্যদের দুর্গতির শেষ ছিল না। তাদের পেটে খাবার, পায়ে জুতা পর্যন্ত ছিল না।
ফ্রান্সের সঙ্গে ইংরেজদের শত্রুতা তখনো চলছে। কানাডা হারিয়ে ফরাসিরা ইংরেজদের ওপর ভীষণ চটে রয়েছে। ফলে আমেরিকানরা ফরাসিদের সাহায্য চাইতেই তারা রাজি হয়ে গেল, কিন্তু একই সঙ্গে তারা দাবি করল যে, তাদের সাহায্য নিতে হলে আমেরিকাকে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হবে। আমেরিকানরা সহজেই এ শর্ত মেনে নিল এবং ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। দুদিক আক্রমণাত্মক যুদ্ধে অবশেষে হেরে গেল ইংল্যান্ড। এরপর ১৭৮৩ সালে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে এ সংগ্রামের হলো অবসান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা স্বীকার করে নিল ইংল্যান্ড। আর ওভাবেই জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে সৃষ্টি হলো বিশ্বের বুকে একটি অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রের।
এবার আসি চার্চিলের কথায়। তীর্যক মন্তব্য চার্চিলের রাজনীতি বিষয়ে। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, ভালো রাজনীতিবিদের যোগ্যতা কী হওয়া উচিত। চার্চিল বলেছিলেন, ‘বিশেষ কিছু নয়। শুধু তাকে দূরদর্শী হতে হবে; সে যেন ভবিষ্যতে কী ঘটবে সেটা ঠিকমতো বলতে পারে। আর যখন সেই ভবিষ্যদ্বাণী মিলবে না, তখন যেন ব্যাখ্যা দিতে পারে, কেন মিলল না।’ এবার চার্চিল সম্পর্কে একটি পরিচিত গল্প বলি। চার্চিলের ৮০ বছরের জন্মদিনে এক তরুণ ফটোগ্রাফার তাঁর ফটো তুলতে গিয়েছিল।
সে মাতব্বরি করে বলেছিল, ‘আমি আশা করি আপনার জন্মশতবর্ষেও এসে এমনিভাবে ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারব।’ তরুণ ফটোগ্রাফারের উৎসাহে এক কলসি ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে চার্চিল তার পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, ‘কেন নয় ছোকরা? তোমার স্বাস্থ্য তো বেশ ভালোই দেখছি। নিশ্চয়ই ততদিন বেঁচে থাকবে।’
দূরদর্শী না হলে রাজনীতি না করাই ভালো। কারণ এরপর যা থাকে তার নাম অপমান। আমাদের দেশে সদার্থক পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। এখন আশার পালা। একটা জাতি কেবল তোষামোদি বা তেলের ওপর চলতে পারে না। বলছিলাম আমরা সত্যিকার অর্থে একটি সুশাসনের সমাজ চাই। সুশাসন ফিরে এলে জাতিকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। যেসব উপরি ঢেউ বা অপবিষয় মাথা চাড়া দিয়েছে সেগুলো অচিরেই বন্ধ করা দরকার। যতকাল পানি ঘোলা থাকবে ততকাল জাতি তার চেহারা ঠিকভাবে দেখতে পাবে না। ঠিকভাবে চেহারা দেখা না গেলে কিছু বোঝাও যাবে না ।
পজিটিভ হওয়ার সময়কালে এ গল্পটি মনে পড়ছে— একবার একদল ব্যাঙ বনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় এ ব্যাঙয়ের দল থেকে দুইটি ব্যাঙ গভীর গর্তে পরে গেল। গর্তটি এতটা গভীর ছিল যে সেটি থেকে উঠে আসা খুবই কঠিন। তবুও ব্যাঙ দুইটি তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করে যাচ্ছিল। দলের অন্য ব্যাঙগুলো বলাবলি করছিল যে এদের এ গর্ত থেকে বের হয়ে আসার কোনো আশা নেই। কিন্তু অদম্য ব্যাঙ দুইটি চেষ্টা করতেই থাকল, তারা প্রাণপণে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদটির ঢালু জায়গা পার করে শেষের দিকের খাড়া অংশের কাছে এসে আবার উল্টো নিচের দিকে পরে যাচ্ছিল। তখন উপরে থাকা বাকি ব্যাঙগুলো চিৎকার করে তাদের বলছিল যে, ‘তোমরা কিছুতেই উপরে উঠতে পারবে না’, ‘এটি খুবই বড় গর্ত’, ‘এখান থেকে উঠে আসা কোনোভাবেই সম্ভব না’ তাদের কথাগুলো এমন ছিল যেন তারা বলতে চাইছে, শুধু কষ্ট করে লাভ নেই, আশা ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুকে স্বীকার করে নাও কষ্ট থেকে মুক্তি পাও।
দুইটি ব্যাঙয়ের মধ্যে একটি তাদের কথায় কান দিল এবং গর্তের উপরের দিকে ওঠা বাদ দিয়ে আরো গভীরের দিকে লাফিয়ে পরে মরে গেল। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যাঙটি আরো উদ্যম নিয়ে লাফাতে লাগল আর উপরে থাকা ব্যাঙরা আরো জোরে চিৎকার করে বলতে লাগল ‘এই বৃথা কষ্ট করো না, মৃত্যুকে সহজ করো”।
কিন্তু ব্যাঙটি অবশেষে উপরে উঠে এলো। উপরে ওঠার পর ব্যাঙটি যা বলল তাতে দলের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ব্যাঙটি বলল- ‘উপরে থেকে তোমাদের চিৎকার করে করে আমাকে উৎসাহ দেয়ার কারণেই আমি মনোবল পেয়ে উপরে উঠে আসলাম।
তোমরা না থাকলে আমি হয়তো হাল ছেড়ে দিতাম। আমি কানে শুনতে পাই না, শুধু চোখে দেখেছি তোমরা গলা ফাটিয়ে আমাকে উপরে উঠে আসতে বলছ’। আশেপাশের মানুষের একটু উৎসাহ মানুষকে কঠিন বিপদেও সামনে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে এবং নেতিবাচক কথায় কান না দিয়ে নিজ লক্ষ্যে অবিচল থাকলে সফলতা আসে। দেশ ভালো থাকুক। ভালো থাকুক আমাদের মানুষজন।
লেখক: সিডনি প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ