মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

এবার এস আলমের সম্পদ কিনতে ‘মানা’

প্রকাশনার সময়: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১৯

কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে হয়েছে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’। প্রথমের শীর্ষ কয়েকটি ব্যাংক দখল করে জামানত ছাড়াই ঋণ নেয় গ্রুপটি। যা বেশির ভাগই দেশের বাইরে পাচার করেছেন এস আলম। নামসর্বস্ব কোম্পানি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে প্রদত্ত ঋণও আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কারণ ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার করে দিয়েছে শিল্প গ্রুপটি। তাই বাধ্য হয়েই এস আলম গ্রুপের পণ্য, জমি ও সম্পদ না কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আহসান এইচ মনসুর। এর আগে এস আলম গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সব ব্যাংকের লেনদেন, ঋণ, এলসি স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন প্রতিষ্ঠানটি নামে-বেনামে থাকা বিভিন্ন জমি-সম্পদ বিক্রি করার চেষ্টা করছে। এগুলো ঠেকাতে আইনি প্রক্রিয়া দরকার। গতকাল বুধবার এস আলমের ব্যাংক লুটের বিষয় উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন ব্যাংক লুটের ঘটনা পৃথিবীতে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। তবে দেশে থাকা তার সম্পদ এবং জমিজমা বিক্রি করে আমরা লুটের টাকা সমন্বয় করার চেষ্টা করব। এজন্য আইনের সহায়তা নেয়ার বিকল্প নেই।

এর আগে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার ছয় ভাই, স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ পরিবারের বেশ কয়েক জনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ। একই সঙ্গে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব এবং অন্যান্য তথ্যও চাওয়া হয়েছে। এছাড়া কব্জায় নেয়া ব্যাংকগুলো এস আলম গ্রুপমুক্ত করার ঘোষণা দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে একে একে এ বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের মালিকানাধীন ব্যাংকের নেতৃত্ব হারাচ্ছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার এস আলমের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপের মাধ্যমে পাঁচটি ব্যাংক এস আলমের দখলমুক্ত করা হলো। এর আগে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক দুটি আদেশে বলা হয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হয়েছে, যে সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে। একই আদেশে বলা হয়েছে, আমানতকারী ও ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং ব্যাংকিং সুশাসন নিশ্চিত করা ও জনস্বার্থে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নতুনভাবে গঠনের জন্য পাঁচ জন করে স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এর আগে গত রোববার বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার লক্ষ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ব্যাংকটি উদ্যোক্তা ও সাবেক চেয়ারম্যান ডা. রেজাউল করীমকে পরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং চার জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ওই ব্যাংকটির পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেয়। একই সঙ্গে আগের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

তার আগে গত ২২ আগস্ট এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ইসলামী ব্যাংকে নতুন পর্ষদ গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকে পাঁচ জনকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। তাদের মধ্য থেকে নতুন পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয়েছে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে। এছাড়া গত ২০ আগস্ট সংকটে থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগের পর এটি এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ ছিল। ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হয় আবদুল আউয়াল মিন্টুকে।

ব্যাংক খাতের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের আগের পরিচালকদের অনেকেই চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জানা যায়, এস আলম গ্রুপ তার নিজস্ব মালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পটপরিবর্তনের পর তার বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা নামে-বেনামে ঋণের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই নামে-বেনামে ৯৫ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছে। এছাড়া সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বের করেছে গ্রুপটি। একইভাবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ।

এদিকে গত ২২ আগস্ট এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা সব ঋণ ও ঋণসুবিধা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি তাদের নামে-বেনামে কোনো আমানত থাকলে তাও উত্তোলন করতে পারবে না গ্রুপটি। এমনকি তাদের নামে থাকা কোনো ক্রেডিট কার্ড দিয়েও লেনদেন করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম গ্রুপের মালিকানায় থাকা ছয় ব্যাংককে এ নির্দেশনা দিয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ও কমার্স ব্যাংক। এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি ইতোমধ্যে ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ন্যাশনাল ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করেছে। এরপরই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে তারা। এসব ব্যাংকসহ অন্য যেসব ব্যাংকে গ্রুপটির নামে-বেনামে ঋণ রয়েছে, সেগুলোতেও নজরদারি শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে, যারা ব্যাংকগুলোয় পরিদর্শন শুরু করেছে।

এর আগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার ভাই ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ঋণ ও আমানতের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। ব্যাংক খাতের সূত্রগুলো বলছে, দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় এস আলমের নামে-বেনামে নেয়া ঋণ দুই লাখ কোটি টাকা হবে, যা ফেরত দিচ্ছে না। ফলে এসব ঋণের তদারকির জন্য এখনই বিশেষ উদ্যোগ না নিলে খাতটি আরও খারাপ হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে এভাবে ব্যাংক লুটপাটের ইতিহাস বিশ্বে আর কোথাও নেই। খুব শিগগিরই ব্যাংক খাতে সংস্কার করা হবে। ব্যাংকের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই। আমানতকারীর টাকা লোকসানে পড়বে না, তবে ধৈর্য ধরতে হবে, সময় দিতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোয় আমানতকারী অতিরিক্ত সুদের লোভে বা দুই শতাংশ সুদ বেশি পাওয়ার আশায় কিছু টাকা রেখেছেন। এখন একসঙ্গে সবাই ব্যাংকে টাকা তুলতে গেলে কীভাবে টাকা পাবেন? এখন ধৈর্য ধরুন, আস্থা রাখুন, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, টাকা পাবেন।

তিনি বলেন, আমরা ব্যাংকের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করব। টাকা ছাপিয়ে আর সহায়তা নয়। এতে কিছু আমানতকারীর লাভ হলেও দেশের জন্য ক্ষতি হয়ে যাবে।

গভর্নর বলেন, ছয়টি ব্যাংকের বোর্ড ইতোমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। সামনে আরও কয়েকটি ব্যাংকের করা লাগতে পারে। খুব দ্রুতই করা হবে। পুরোনো বোর্ড দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যাচ্ছিল না, তাই বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। এখন ব্যাংকগুলো কীভাবে রিস্ট্রাকচার করা হবে এটা আমাদের পরবর্তী কাজ। কোন মডেলে কাজ করা হবে এবং কাদের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা চাইতে পারি।

এস আলমের ব্যাংক ঋণ শোনা যাচ্ছে দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে— এমন তথ্য তুলে ধরে এক সাংবাদিক জানতে চান এটা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারি কিনা। জবাবে আহসান মনসুর বলেন, আমার জানা মতে আর নাই। দুই-একটা খুঁজে দেখতে হবে আর আছে কি না। কুয়েত ইনভেশনের সময় তখন ফান্ডের টাকা এদিক-সেদিক হয়ে গেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করার এমন ঘটনা আমি কোথাও শুনি নাই।

এ সময় ইসলামী ব্যাংক পুনর্গঠনের বিষয়ে এক প্রশ্নে গভর্নর বলেন, ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কাজ করবে। এখানে একমাত্র আমানতকারীদের স্বার্থ জড়িত। বোর্ড দেওয়া হয়েছে। দরকার হলে বোর্ড পরিবর্তন করা হবে। প্রতেকেই যদি দায়িত্ব নিয় কাজ করে। আমরা তাদের সব রকম আইনি সহায়তা দেব। তারা যদি সহায়ক ভূমিকা পালন না করে, তাহলে বোর্ড পরিবর্তন করা হবে। তাদের মনে রাখতে হবে তারা সরকারের প্রতিনিধি। তারা জনগণের জন্য নির্মোহভাবে কাজ করবে। ব্যাংক ও আমানতকারীদের স্বার্থের জন্য তারা যদি কাজ না করেন; কোনো ধরনের ম্যালপ্রাক্টিস (অসদাচার) হলে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ