বাড়ছে নগরায়ণ, বাড়ছে তাপমাত্রা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পানির চাহিদা। তবে পানি উত্তোলন ও নগরায়ণের কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে যেতে না পারায় প্রতি বছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে দুই থেকে তিন মিটার করে, যা ৯ থেকে ১০ ফিটের মতো। প্রতি বছর যে হারে ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, তাতে যে কোনো সময় ঢাকায় ভূমি ধসের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায় ঢাকা ওয়াসা।
জানা গেছে, ঢাকার দৈনিক পানির চাহিদা এখন ২১০ থেকে ২৬০ কোটি লিটার। উৎপাদন ক্ষমতা আছে ২৮০ কোটি লিটার। ঢাকার পানি সরবরাহের ৬৬ শতাংশ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে মেটাতে হচ্ছে ঢাকা ওয়াসাকে। আর বাকি ৩৪ শতাংশ পানির চাহিদা মেটাতে হয় নদীর পানির পরিশোধন করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ গবেষণা বলছে, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটার নিচে, যা ২০০৫ সালে নেমে গেছে ৪৫ মিটারে, ২০১১ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৩ সালে ৭৫ মিটার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০-১২ বছর পর এটা ১৩২ মিটারে নেমে যেতে পারে।
এদিকে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমাতে ২০২৯ সাল নাগাদ ৬৭ শতাংশ পানির চাহিদা মেটাতে নদীর পানির ওপর নির্ভর করতে চায় সংস্থাটি। ভূগর্ভস্থ পানির উৎস হতে চাহিদা মেটানো হবে ৩৩ শতাংশ। সেজন্য পদ্মা মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে সরবরাহে জোর দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। নেয়া হয়েছে প্রকল্প। ঢাকার চার পাশের নদীগুলোর দূষণের মাত্রা বেশি থাকায় পরিশোধন করা সম্ভব নয় বলেই পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে পানি আনতে হচ্ছে। যা অনেকটাই ব্যয় বহুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন আহমেদ বলেন, কাদামাটির স্তরগুলো বালির স্তরগুলোর ঠিক বিপরীত আচরণ করে। কাদার স্তরে (যার পুরুত্ব ৬০ ফুট পর্যন্ত) কোনো অব ডিপ্রেশন তৈরি হলে ভূমিধস হতে পারে এবং ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ অসীম না। সরকারকে অবশ্যই জাতীয় অগ্রাধিকার বিবেচনায় এর ব্যবস্থাপনা করতে হবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে এর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাউবোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির স্তর ছিল ২৫ মিটারে, যা ২০০৫ সালে ৪৫ মিটার, ২০১০ সালে ৬০ মিটার এবং ২০২৪ সালে এসে ৮৬ মিটারে নেমেছে। প্রতি বছরই ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর দুই থেকে তিন মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিরেক্টর আনোয়ার জাহিদ সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জানান, বর্তমানে পানির চাহিদা প্রচুর বাড়ছে, তবে পরিমাণ বাড়ছে না। ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ কমে আসছে। ঢাকায় যেখানে ৫০ বছর আগে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার দুই থেকে তিন মিটারের মধ্যে ছিল, বর্তমানে সেখানে ৮৬ মিটারে নেমে গেছে। এটা আমাদের জন্য খুবই অ্যালার্মিং। তবে কিছু কিছু এলাকায় বোরো মৌসুমে পানির লেয়ার নিচে নামলেও আবার বৃষ্টির সময়ে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসে। তবে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায়ই পানির লেয়ার শুধু নামছেই, কখনো আর ওপরে উঠছে না। ঢাকায় পানির লেয়ার সবচেয়ে বেশি নিচে। উদ্বেগের ব্যাপার হলো, ব্যবহারযোগ্য পানি আছে কি না, কত পরিমাণ আছে— এসব বিষয় দেখার মতো কেউ নেই।
ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালে ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণী গবেষণা অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে শুধু ঢাকা থেকেই ৮৫ শতাংশ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি এ সময়কালে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকার পুকুরের চিত্র। গবেষণার তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকায় মাত্র ২৪১টি পুকুর এবং ৮৬টি বিল ও লেক রয়েছে, যা মোট জলাভূমির ২২ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পুকুর রয়েছে ৪৩টি। পুকুর, বিল ও লেক মিলিয়ে ৩২৭টি জলাশয় রয়েছে। পুকুর, জলাশয়, লেক ভরাট করে চলছে স্থাপনা নির্মাণের কাজ। কোথাও ভরাট করে বহুতল ভবন, আবার কোথাও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং মার্কেট নির্মাণও করা হয়েছে। দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ছিল ২৬ শতাংশ, ইট-বালু ব্যবসায়ীদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৩২ শতাংশ, ভূমিহীনদের দ্বারা ভরাট হয়েছে ৩২ শতাংশ।
নগর পরিকল্পনাবিদ বিআইপি সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ বিষয়ে বলেন, একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা দরকার। দুঃখের বিষয়, ঢাকা সিটিতে জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম। এ শহরের জলাভূমি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। এটা বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। জলাশয় ভরাটকারীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।
সদ্য বিলুপ্ত জাতীয় সংসদেও বিষয়টি উঠেছিল। এ নিয়ে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ওই সংসদে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ২ থেকে ৩ মিটার নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরের গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর এলাকাভেদে ৩৮ থেকে ৮২ মিটার আর চট্টগ্রাম শহরে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১০০ মিটার নিচে।
ওই সময়ে তিনি আরো বলেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে রাজধানীতে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে ভূপৃষ্ঠস্থ উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বৃহৎ ৩টি পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে ৭০ ভাগ ভূপৃষ্ঠস্থ পানি আর ৩০ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর নির্ভরতা নিশ্চিত করে ঢাকাবাসীর মধ্যে পানি সরবরাহ করা হবে। এর ফলে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) অর্জন সম্ভব হবে। একটি আদর্শ শহরে যেখানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ জলাভূমি থাকা আবশ্যক, সেখানে রাজধানী ঢাকায় জলাভূমি রয়েছে ৩ শতাংশেরও কম। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকায় একের পর এক জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, বিপণিবিতান, সরকারি দপ্তর গড়ে উঠছে, যা এ নগরবাসীর জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনছে; গ্রীষ্মে দাবদাহ বর্ষায় জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে; দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীর। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সময়কালে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকা জলাশয় ও নিম্নভূমির পরিমাণ আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ