বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে উজান থেকে নেমে আসা পানিতে মৌসুমী বন্যা দেখা দিয়েছে এসব অঞ্চলে। ত্রিপুরার গোমতী জেলার গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ডম্বুর স্লুইস গেট খুলে দেয়ার ফলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা হয়েছে বলে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। অতিবৃষ্টি আর ডুম্বুর স্লুইস গেট খুলে দেয়া যে কারণেই হোক, একের পর এক বন্যায় বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বাসিন্দারা। এসব জেলার লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। পানি ঢুকে পড়েছে ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়ও। বিদ্যুৎ ও মোবাইল স্টেশন ডুবে যাওয়ায় এসব এলাকার অনেক স্থানের বিদ্যুৎ ও মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। অনেক এলাকায় সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বন্যার্ত মানুষ উঁচু স্থান, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছেন।
অনেকের হাতে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে- এক কথায় নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। বন্যাকবলিতদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য সরকার ইতোমধ্যে এসব এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস মোতায়েন করা হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পশ্চিম দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের আকাশে প্রবেশ করে। অন্যদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে আসা লঘুচাপ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে কুমিল্লা- নোয়াখালীর সীমানায় চলে আসে। আর মৌসুমি বায়ুও এ সময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই তিন মিলে বিপুল পরিমাণ মেঘ কুমিল্লা-নোয়াখালীর আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। একসময় তা বিস্ফোরিত হয়ে জনপদে নেমে আসে যা মেঘ বিস্ফোরণ বা ‘ক্লাউড ব্লাস্ট’ নামে পরিচিত। এই মেঘ বিস্ফোরণের শুরু ১৯ আগস্ট সকালে। এরপর টানা তিন দিন প্রবল বর্ষণ আর উজান থেকে আসা ঢল দেশের পূর্বাঞ্চলকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। মেঘ বিস্ফোরণ বিস্তৃত ছিল ভারতের ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশের কুমিল্লা-ফেনী পর্যন্ত ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ১৯, ২০ ও ২১ আগস্ট এ এলাকায় অতি ভারি বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, আগামী তিন দিনে এ বৃষ্টি কমে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। কিছু এলাকায় মাঝারি থেকে ভারি ও অতি ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে অধিদপ্তর।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলেছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় কমতে পারে বলে পূর্বাভাসে বলা হয়। পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ভারত ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছেন ত্রিপুরার বিদ্যুৎমন্ত্রী রতন লাল নাথ। তিনি বলেন, ‘গোমতী হাইড্রো ইলেকট্রিক প্রজেক্টের গেট খুলে দিয়েছি, এ তথ্য সঠিক নয়। যে প্রচারটা করা হচ্ছে ডুম্বুর গেট খুলে দেয়া নিয়ে, সেটা অপপ্রচার ছাড়া কিছু না।’ তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ২২ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে এক লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ত্রিপুরা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যা হয়েছে। আমরা লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশের তরফে অভিযোগ উঠছে, ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের জল ছেড়ে দেয়ায় সেই দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এটা তথ্যগতভাবে ভুল।’
একই সুরে কথা বলেছেন, ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে তার কার্যালয় ‘যমুনায়’ যান ভারতীয় হাই কমিশনার। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের হাই কমিশনার প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, ত্রিপুরায় অনেক বৃষ্টি হয়েছে। পানির উচ্চতার কারণে বাঁধ থেকে অটোমেটিক পানি রিলিজ হয়েছে। তিনি বলেন, ত্রিপুরায় বন্যা অপ্রত্যাশিত যা দুই দেশেরই সমস্যার কারণ।
কিন্তু ত্রিপুরার গণমাধ্যম বলছে ভিন্ন কথা। ত্রিপুরার সংবাদমাধ্যম বোরক টাইমসের খবরে জানা যায়, ১৯৯৩ সালের পর প্রথমবারের মতো ত্রিপুরার ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ খুলে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ত্রিপুরার রাজস্ব সচিব ব্রিজেশ পাণ্ডে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরা ও গোমতী জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে।
বুধবার (২১ আগস্ট) স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত বাঁধের তিনটি গেটের মধ্যে একটি খুলে দেয়া হয়েছে। খোয়াইয়ের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট চাঁদনি চন্দ্রন জানিয়েছেন, খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় জেলার দু’টি মহকুমা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি স্থানীয় বাসিন্দাদের নদীর কাছে মাছ ধরা এড়িয়ে চলতে এবং ভূমিধস প্রবণ এলাকা থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাছাড়া, ত্রিপুরার গোমতী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে জানিয়েছেন, গোমতী নদীর পানি আরো বাড়তে পারে। একই পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে খোলা হয়েছিল ডুম্বুর বাঁধ। এর ৩১ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ফের বাঁধটি খুলে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
পাহাড়ি ঢল আর টানা বৃষ্টির কারণে এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদ-নদীতে পানি আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যান্য জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা কয়েক লাখ এবং এসব মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন তারা। অনেকেই পরিবারসহ ছোট ছোট নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেই অনাহারে অর্ধাহারে চলছে তাদের বানভাসি জীবন যাপন। দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। অনেক জায়গায় বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ। সরকারের ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মানুষকে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি করে তোলে। তাই অতিবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসহায় মানবতার পাশে দাঁড়ানো দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অবশ্য কর্তব্য। বিপদের সময় বানভাসি মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। বিপদগ্রস্ত লোকরা সাহায্যের অর্থ, ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন, বিশুদ্ধ পানি বা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে খুবই উপকৃত হয়। যারা অসহায়, ক্ষতিগ্রস্ত, অভাবী, গরিব-দুঃখী এবং অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানহীন মৌলিক অধিকার বঞ্চিত মানুষকে ত্রাণ সাহায্য করে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন, তারাই সত্যিকারের মানব দরদি।
বন্যায় অনেক দরিদ্র পরিবারের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ ও জীবন-জীবিকার ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বহু রাস্তাঘাট, দোকানপাট, বসতভিটা, জমি-জিরাত ও ফল-ফসল নিশ্চিহ্ন ও বিলীন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বন্যাকবলিত অঞ্চলের অসহায় বানভাসি মানুষ কতটা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়েছে, তা সহজেই অনুমেয়। বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় পানিবাহিত নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের অভাবে তারা সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় প্রবল স্রোতে পানির সংযোগ পাইপ, গভীর নলকূপ ও কুয়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্র বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মানবেতর জীবন যাপনরত বানভাসি মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ত্রাণ তৎপরতা, শুকনা খাদ্যসামগ্রী প্রদান, আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
দেশের ১১টি জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে অসহায় মানুষ যখন পানিবন্দি অবস্থায় জীবন যাপন করছে, তখন সমাজের বিত্তবানদের বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও সাহায্য সহযোগিতা করা নৈতিক দায়িত্ব। টাকাপয়সা, খাদ্য, বস্ত্র, পানি, ওষুধ— যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসার এখনই সময়। বন্যা উপদ্রুত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয় ও চিকিৎসার অভাবে অর্ধাহারে অনাহারে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে দিন যাপন করছে। দুঃখের রজনি যেমন শেষ হতে চায় না, তেমনি বানভাসি মানুষের কাছে এখন একেকটি দিন যেন দুর্বিষহ কষ্টের অনন্তকাল।
আসলে সমাজে যারা বিত্তবান, তারা সবাই চিত্তহীন নন, বর্তমান প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না। এজন্য দেশের ধনাঢ্য ও সংগতিসম্পন্ন লোকরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজনকে মুক্ত হস্তে সাহায্য করতে পারেন। সুতরাং যে প্রান্তেই থাকুন, নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বন্যার্তদের সাহায্য সহযোগিতা করুন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহ, সাহায্য-সহযোগিতা ও বিতরণের সময় স্থানীয় প্রশাসন, উন্নয়নকর্মী বা স্বেচ্ছাসেবী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তাই সরকারের ত্রাণের দিকে না তাকিয়ে আর্ত মানবতার সেবায় সবাই স্বেচ্ছায় যথাসাধ্য সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন! ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যত বড়ই হোক না কেন, তার মোকাবিলা করা কঠিন হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু।
লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ