কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ক্যাম্পের ভেতরে গতকাল বুধবার রাতের আধারে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহ মারা গেছেন।
ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের সাথে তার পরিচিত ব্যক্তিরা জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
"যেহেতু হত্যাকারীরা তার কাছে যেতে পেরেছিলেন এবং তার সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন, তারা তার পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন বলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের মনে হচ্ছে," বলেছেন আর্মড পুলিশ ব্যাটলিয়ন ১৪'এর কমান্ডিং অফিসার পুলিশ সুপার নাইমুল হক।
অপরাধ করে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া সম্ভব :
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে দিনের বেলায় এক রকম চিত্র থাকলেও রাতের বেলায় চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র পদচারণা শুরু হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই। অন্যদিকে পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। ক্যাম্পের ভেতরে বড় কয়েকটি সড়ক তৈরি করা হয়েছে যেগুলো ‘আর্মি রোড’ হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এসব রাস্তার মাধ্যমে সব জায়গায় পৌঁছানো যায় না। এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে পৌঁছাতে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তায় অনেকক্ষণ হাঁটতে হয়। ফলে যেকোনো অপরাধ করে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। রাতের বেলায় এসব জায়গায় যেতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও নিরাপদ বোধ করে না।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব :
শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাম্পের ভেতরে একটি অংশ আছে যাদের ‘কাফের’ বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সন্দেহ করে অপরপক্ষ। এসব ব্যক্তি এখনও ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের গোয়েন্দাদের তথ্য দেয় বলে তাদের প্রতিপক্ষের অভিযোগ। ক্যাম্পের ভেতরেই একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে যারা তাদের দৃষ্টিতে ‘কাফের’ চিহ্নিত করার কাজ করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইউনুস দোভাষীর সাহায্যে বলেন, ‘যাদের হত্যা করা হয়েছে তারা সবাই মোনাফেক। কোনো ভালো মানুষকে হত্যা করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে অনেকে আছে যারা মিয়ানমার বাহিনীর কাছে ‘তথ্য পাচার’ করে। পুলিশ বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে দুই বছরে অন্তত ৪৫টি খুন হয়েছে, যার বেশকিছু পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, ক্যাম্পের ভেতরে তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথা না শুনলে পরিণতি হয় ভয়াবহ। হত্যাকান্ডের আরেকটি কারণ আছে।
স্থানীয় প্রশাসনের এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে যারা কিছুটা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে তাদের বেশ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যেই অনেকে চায় না যে অন্য কেউ প্রভাবশালী হয়ে উঠুক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্যাম্পের ভেতরে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
‘ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পের ভেতরে একটা কথা প্রচলিত আছে, ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় সশস্ত্র গোষ্ঠীর। এটা এখন ওপেন সিক্রেট।’ কর্মকর্তারা বলছেন, এই সশস্ত্র গোষ্ঠী চায় না যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে চায়। এর মাধ্যমে সেই সশস্ত্র গোষ্ঠী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে বলে মনে করেন সে কর্মকর্তা। সম্প্রতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়ার পর সে গোষ্ঠী অনেক রোহিঙ্গাকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে যাতে তারা ফিরে যেতে রাজি না হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা :
কক্সবাজারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার মধ্যে স্থানীয় প্রশাসন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তা, পুলিশ এবং বিজিবি সূত্রগুলো জানায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট যখন শুরু হয়, তখন অনেকেই আশঙ্কা করে যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ঘিরে জঙ্গি তৎপরতা তৈরি হতে পারে। এর একটি বড় যুক্তি ছিল, জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো হয়তো তাদের সদস্য সংগ্রহের জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে টার্গেট করতে পারে। তা ছাড়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে মিয়ানমার বাহিনীর ওপর।
সে জন্য তারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে পারে এমন আশঙ্কাও ছিল অনেকের মনে। এই আশঙ্কা এখনও রয়েছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশে সরকার। স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, আগামী কয়েক বছর পর রোহিঙ্গারাই ক্যাম্পগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে।’ সে কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে টাকা আয় করে নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য খরচ করে তারা। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আশরাফুল আফসার বলেন, রোহিঙ্গাদের ‘নিজস্ব দ্বন্দের’ কারণে খুনোখুনিগুলো হচ্ছে এবং তার প্রভাব কক্সবাজারের আইশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরও পড়ছে। ‘সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে টেনশন তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
এনজিও কর্মীদের উদ্বেগ :
কক্সবাজারে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক কর্মকর্তার আশঙ্কা, শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি যেভাবে দিনকে দিন জটিল হয়ে উঠছে তাদের ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপদে কাজ করা মুশকিল হয়ে উঠতে পারে। এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের মাঝে এনজিও কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সেটি না থাকলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য যদি আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে যায় তাহলে সেটির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রোহিঙ্গাদের ওপর। এখনও পর্যন্ত তারা এনজিও কর্মীদের সুদৃষ্টিতে দেখে। এর কারণ হচ্ছে, এনজিওদের কাছ থেকে তারা নানা সাহায্য পাচ্ছে। যদি সাহায্যের মাত্রা কমে আসে তাহলে অচিরেই এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বেসরকারি সংস্থাগুলো এরই মধ্যে ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন, বেসরকারি সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বেশি ত্রাণ সাহায্য দিচ্ছে বলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবার আগ্রহ পাচ্ছে না। এমন অবস্থায় বেসরকারি সংস্থাগুলো রয়েছে উভয় সংকটে।
কী করবে প্রশাসন?
নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দিকে তাদের তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে তাদের। নিরাপত্তা ইস্যুতে ছয় মাস যাবৎ রোহিঙ্গাদের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। কোনো রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার ন্যূনতম প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি তাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে এক কর্মকর্তা বলেন, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা বাহিনী কোনো অভিযান পরিচালনা করলে সেটির আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। তা ছাড়া যেকোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা হলে সাধারণ রোহিঙ্গারাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারে।
এ ছাড়া বিষয়টিকে মিয়ানমার সরকার এমনভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে পারে যে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসীরা আছে। ফলে বিষয়টি তাদের পক্ষে যেতে পারে।
তবে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, শরণার্থী ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। সে জন্য নিরাপত্তা বাহিনীগুলো এখন ভিন্ন কৌশলে হাঁটছে।
একজন কর্মকর্তা জানালেন, তারা বেছে বেছে পদক্ষেপ নেবেন। অর্থাৎ যাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ সংগঠনের ন্যূনতম প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হবার ঘটনাগুলো সে বিষয়টি প্রমাণ করে বলে মন্তব্য করেন এক কর্মকর্তা।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলছেন, পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সে জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ