ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বাকরুদ্ধ বানভাসিরা

প্রকাশনার সময়: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪২

উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও ভারি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় চরম বিপাকে পড়েছেন ১১ জেলার লাখ লাখ মানুষ। হঠাৎ ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া ও বানের পানিতে গবাদিপশু ও মাছসহ দৈনন্দিন জিনিসপত্র ভেসে যাওয়ায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বানভাসিরা। সব হারিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। এদিকে গত কয়েক দিনের বন্যায় দুই নারীসহ ১৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সাত জেলায় এসব মৃত্যু ঘটে।

আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১টি জেলা আক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯। এসব জেলায় বন্যাকবলিত হয়ে মারা গেছেন ১৫ জন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এক তথ্য বিবরণীতে এ তথ্য জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।

এতে বলা হয়েছে, আকস্মিক বন্যায় দেশের ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলার ৭৭টি উপজেলা এবং ৫৮৯টি ইউনিয়ন বা পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। এই ১১ জেলায় মোট ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। যাতে মোট ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন।

এখন পর্যন্ত বন্যায় মৃত ১৫ জনের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এদের মধ্যে দুজন নারী। আর জেলাভিত্তিক হিসাবে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ৪ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন এবং কক্সবাজারের ৩ জন মারা গেছেন।

পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় প্রদানের জন্য মোট ৩ হাজার ১৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেগুলোতে মোট ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩০ জন লোক এবং ১৮ হাজার ৯৬টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

বিবরণীতে বলা হয়েছে, ১১টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৬৩৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়গুলো থেকে ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা ২০ হাজার ১৫০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।

এদিকে ফেনী, কুমিল্লাসহ পাঁচ জেলায় ধীরগতিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার তথ্য দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাগুলোতে ভারি বৃষ্টিপাত হয়নি। সেই সঙ্গে উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাওয়া শুরু করেছে। তাতে করে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে বুলেটিনে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের মনু, খোয়াই ও ধলাই নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। এদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানেও ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময়ে ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদী সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বুলেটিনে বলা হয়েছে, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে এবং গঙ্গা ও পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল আছে; যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় হ্রাস পেতে পারে বলে বুলেটিনে বলা হয়েছে।

এছাড়া উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকবে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, গতকাল শুক্রবার সারা দিন ত্রিপুরা রাজ্যে পানি নেমে আসার কারণে কুমিল্লা ও ফেনী জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলো আজ (গতকাল) সারা দিন চট্টগ্রাম বিভাগ ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপরে খুবই কম পরিমাণে বৃষ্টির সম্ভাবনা নির্দেশ করছে। ফলে আশা করা যাচ্ছে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে কুমিল্লা ও ফেনী জেলার নদ-নদীগুলোর উজানে পানির উচ্চতা কমা শুরু করবে। আজ শনিবার থেকে আরো দ্রুত বন্যার পানি কমা শুরু করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উন্নতির জন্য রোববার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ত্রিপুরায় আপাতত বৃষ্টি নেই। গত দুদিনের চেয়ে শুক্রবার পানি কম প্রবেশ করছে।

তিনি আরো জানান, গত দুই দিনে পানি বাড়ার হিসাব অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ১৯৯৭ সালে নদীটিতে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল।

এই বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, ত্রিপুরায় ২৬ তারিখ পর্যন্ত ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশে আজ বিকেল থেকে ওই অঞ্চলে বৃষ্টি কমতে পারে। তবে আমাদের বন্যা দেশের বৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ত্রিপুরা ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বৃষ্টির ওপর এখানকার বন্যা নির্ভর করছে

কোন নদী বিপৎসীমার কত উপরে: পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৯টায় খোয়াই নদীর পানি সিলেটের বাল্লা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর হবিগঞ্জ পয়েন্টে এই নদীর পানি যাচ্ছিল ১৬৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।

কুমিল্লায় গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যেখানে দেবীদ্বার পয়েন্টে পানি যাচ্ছিল বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। চট্টগ্রামের রামগড় স্টেশনে ফেনী নদীর পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ২১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে।

চট্টগ্রামে হালদা নদীর পানি নারায়ণহাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যাচ্ছিল, আর পাঁচপুকুরিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। সকালে মৌলভীবাজার পয়েন্টে মনু নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর ফেনীর পরশুরাম স্টেশনের সঙ্গে ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন’ হওয়ায় সেখানকার মুহুরী নদীর বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কুমিল্লা: ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার রেকর্ডসংখ্যক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উচ্চ প্রবাহের ফলে ভেঙে গেছে নদীর বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকার বাঁধ। এতে বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

বৃহস্পতিবার দিনগত রাত ১২টার দিকে নদীর বেড়িবাঁধের বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম।

শুক্রবার সকালে ভেঙে পড়া বাঁধ এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের অন্তত ২০০-২৫০ ফুট অংশ পুরো ধসে গেছে। ধসে পড়া বাঁধ দিয়ে অবিরত পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পানির এমন প্রবাহের ফলে বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামসহ অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আতঙ্কিত মানুষজন বেড়িবাঁধের ভাঙন থেকে ২ কিলোমিটার দূরে সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও আটকে পড়া বেশ সংখ্যক মানুষ খোলা আকাশের নিচে কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফেরেন।

শুক্রবার সকালে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া সেসব মানুষদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। শিরিন বেগম নামে এক পঞ্চাশোর্ধ নারী বলেন, আমার কোনো ছেলে নেই। দুইটা মেয়ে। স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। কোনোরকমভাবে একটা ঘর তৈরি করেছিলাম। রাতে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে কোনোরকম জীবন বাঁচিয়ে রাস্তায় আসি। আমার সব শেষ হয়ে গেল।

হেলানা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, জীবনে প্রথম পানির এত প্রবাহ দেখলাম। গরু-ছাগল সব রয়ে গেছে। জীবনটা বাঁচিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে এসেছি। ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল সব পানিতে তলিয়ে গেছে। শমসের আলী নামে এক বানভাসি বলেন, রাতে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে হাতে যা পেয়েছি তা নিয়ে উঠে এসেছি। চোখের পলকে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল।

অপরদিকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া বানভাসি এসব মানুষ অভিযোগ করে বলেন, গতকাল রাত থেকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিলেও কোনো খাদ্য সহায়তা তো দূরের কথা, প্রশাসনের একজন লোকও এখন পর্যন্ত আমাদের দেখতে আসেনি।

বুড়বুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, আত্মীয়স্বজনরা সকাল থেকে খাবার নিয়ে দেখতে এসেছেন। প্রশাসনের কেউ এ পর্যন্ত এখানে আসেনি। আমারা শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে আছি।

মমিনুল হক নামে একজন বলেন, আমরা যারা গরীব মানুষ আছি, আমাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। পানিতে আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। অথচ প্রশাসনের কেউ সামান্য সহানুভূতিও দেখাতে আসেনি। এ বিষয়ে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, খোলা আকাশের নিচে কারও আশ্রয় নেয়ার কথা না। আমরা সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বলেছিলাম। তবুও যারা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেয়া হবে।

অপরদিকে গোমতীর বাঁধ ভাঙার খবরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্পিডবোট ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে অনেকে এসেছেন এসব এলাকায়।

পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করছেন তারা।

নরসিংদীর রায়পুরা থেকে আসা জামাল আহমেদ নামে এক যুবক বলেন, আমরা ১০ জনের একটি টিম এক ট্রাক খাবার সামগ্রী ও দুইটা স্পিড বোট নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে অন্তত ৪০ জন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছি। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।

অপরদিকে সেনাবাহিনীর পক্ষে থেকে জানানো হয়েছে, বুড়িচংয়ে প্রায় ১৫০ জন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করেছেন সেনা সদস্যরা। সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ ফুটের মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। পানি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। গোমতীর পানি এখনো বিপৎসীমার ওপরে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় পানি ছিল ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপরে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৬টায় তা কমে গিয়ে বিপৎসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। এখন আরো কমেছে।

লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে কমেছে ভারি বর্ষণ। ফলে সকাল ৮টার পর থেকে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে জলাবদ্ধতা হয়ে দুর্ভোগ বেড়েছে। কমলনগর, রায়পুর ও রামগতির বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে না। কোথাও কোথাও রোদ দেখা গেছে। আবার কোথাও গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রামগতি, কমলনগর, রায়পুর, রামগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর সদরের একাংশে অন্তত ৬ লাখ মানুষ পানির কষ্টে রয়েছেন। অনেকের বসতঘর পানিতে ডুবে আছে। কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের সর্বত্র এখন ৪ ফুট পানির নিচে। ভুলুয়া নদীর দক্ষিণ প্রান্তে আজাদনগর স্টিল ব্রিজ এলাকাসহ বিভিন্ন অংশ দখলের কারণে আশানুরূপভাবে পানি নামছে না। ভুলুয়া নদীর সঙ্গে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর ২০টি ইউনিয়নের মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অবৈধ দখলদারের কারণে রহমতখালী ও ডাকাতিয়া নদীর পানি নামতেও বেগ পেতে হচ্ছে। স্থানীয় পাউবো সূত্র জানায়, গতকাল শুক্রবার মেঘনা নদীতে সকাল সাড়ে ৭টার থেকে ভাটা চলছে। বিকেল ৫টা থেকে ৭টা পর্যন্ত জোয়ার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। জোয়ার সময় পাউবোর স্লুইস গেটগুলো বন্ধ রাখা হয়। এতে নদীর পানি ভেতরে ডুকে না। রামগতির চরপোড়াগাছা গ্রামের শেখের কিল্লা এলাকার বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম ও আরিফ হোসেন বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনেসহ আশপাশে কোমর পর্যন্ত পানি জমে আছে। একটুও পানি নামছে না। বাড়িতে হাঁটুপানি। আমাদের ঘরে আরও ৫টি পরিবারকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। গত কয়েক দিন ইট বসিয়ে রান্না করতে হয়েছে। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানির কারণে আগুন জ্বলছে না। রায়পুরের খাসেরহাট নাইয়াপাড়া জেলে সমিতির সভাপতি মোস্তফা বেপারী বলেন, জমে থাকা পানি নদীতে নামছে। ভারী বৃষ্টি না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে সময় লাগবে। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, লক্ষ্মীপুরে আর ভারী বৃষ্টি না হলে চলমান জলাবদ্ধতার সংকট ৩ দিনের মধ্যে কেটে যাওয়ার আশা করছি। লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। অসহায় মানুষদের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: আখাউড়ায় তীব্র স্রোতের কারণে সেতু ধসের আশঙ্কায় কসবা উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও আরো একটি সেতু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তা ধসে গেলে পৌর এলাকার দেবগ্রামের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দুই পাশে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটির মাটি সরে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে কয়েকটি এলাকা বিদ্যুৎহীন রয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, পৌর এলাকার দেবগ্রাম ও মোগড়া ইউনিয়নের নয়াদিলের সংযোগস্থলের সেতু বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ঝুঁকির মধ্য পড়ে। সেতুর এক পাশের দেয়াল ধসে পড়লে আতঙ্ক দেখা দেয়। পরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা গাছ ফেলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি জানান, সেতুর বিষয়ে অবগত রয়েছি। ঝুঁকি থাকায় সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

মৌলভীবাজার: টানা ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢলের কারণে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুড়ী, কমলগঞ্জ, রাজনগর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে। এ বন্যায় অসংখ্য ঘরবাড়ি, গ্রামীণ সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে গেছে। এর ফলে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সিলেটের সঙ্গে মৌলভীবাজারের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। গতকাল শুক্রবার মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুপুরের আপডেট তথ্য অনুযায়ী মৌলভীবাজারের ৪টি নদীর পানির পানি ৫টি পয়েন্টের ৩টির মাঝে কমেছে। বাকি পয়েন্টগুলোতে অপরিবর্তিত আছে। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, মনু নদীর রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৩ সেন্টিমিটার দিয়ে ও মনু নদীর চাঁদনীঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১১৩ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই নদীর রেলওয়ে ব্রিজ পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ১০৭ সেন্টিমিটার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার দিয়ে ও জুড়ী নদীর ভবানীপুর পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ১৯৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সমন্বয় সেল গঠন : বন্যা মোকাবিলায় ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সহায়তা সমন্বয় সেল’ গঠন করার কথা জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সমন্বয় সেল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে প্রাপ্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে।

প্রয়োজনে ০২-৪৭১১৮৭০০, ০২-৪৭১১৮৭০১, ০২-৪৭১১৮৭০২, ০২-৪৭১১৮৭০৩, ০২-৪৭১১৮৭০৪, ০২-৪৭১১৮৭০৫, ০১৩১৭৭৪৯৯৮০ এবং ০১৮২০১১৭৭৪৪ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এর আগে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ০২৫৫১০১১১৫ নম্বরে ফোন করা যাবে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা জানিয়েছে।

দুর্গতদের ০১৩৩১৮২৩৪৯৬২, ০১৭৬৫৪০৫৫৭৬, ০১৫৫৯৭২৮১৫৮ ও ০১৬৭৪৩৫৬২০৮ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খুলেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। সহায়তার প্রয়োজন হলে ফোন করা যাবে ০১৩১৮২৩৪৫৬০ নম্বরে। আর বন্যার মধ্যে টেলিযোগাযোগ সেবা সচল রাখতে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করার কথা জানিয়েছে বিটিআরসি।

বিটিআরসির ইমার্জেন্সি রেসপন্স দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে +৮৮০২২২২২১৭১৫২ নম্বরে ফোন করতে হবে। বিটিআরসির কল সেন্টার ১০০ ব্যবহার করেও ওই দলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

ফেনীর ৯২ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল

ফেনী : জেলায় ৯২ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকা এবং টাওয়ার এলাকা ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক সচল করা যাচ্ছে না। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অন্য ১০ জেলার প্রায় ১১ শতাংশ টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে।

শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত বন্যাকবলিত অঞ্চলের মোবাইল নেটওয়ার্ক পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্যে এ কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।

সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় টাওয়ার সচল করতে সমন্বয়ের কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিটিআরসি। তবে যেসব টাওয়ার এলাকা ডুবে গেছে, পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত সচল করার কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। ফেনী জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত টাওয়ার সচল করা কাজ চ্যালেঞ্জিং ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় সেখানে যোগাযোগ স্থাপন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করেছে বিটিআরসি।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ