বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) বিপুল পরিমাণ বকেয়া থাকায় জ্বালানি তেল আমদানি নিয়ে সংকটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিপিসির কাছে ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি। যদিও বিপিসির কাছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি নগদ অর্থ বিভিন্ন তফশিলি ব্যাংকে জমা রয়েছে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় সেপ্টেম্বর থেকে নির্ধারিত তারিখে তেল আমদানি করা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানিতে সংকট দেখা দিলে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় পড়বে দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার- ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। যার প্রভাব পড়তে পারে সারা দেশে। দেশে ব্যবহূত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। নিয়মিত খুচরা মূল্য সমন্বয় করায় বর্তমানে প্রতি মাসে তেল বিক্রি থেকে যে পরিমাণ টাকা আয় হয় তা দিয়েই আমদানি বিল পরিশোধ করা সম্ভব। বরং বিক্রীত অর্থ থেকে কিছু লাভও হয় বিপিসি এবং বিপণনকারী কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের। কিন্তু সমস্যাটা হলো, টাকায় বিক্রি করলেও আমদানি হয় মার্কিন ডলারে। কিন্তু দেশে ডলার সংকট থাকায় নির্ধারিত পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি। এ অর্থের সংস্থানও করতে পারছে না সংস্থাটি। এমন পরিস্থিতিতে বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে বাংলাদেশের কাছে তেল বিক্রি করবে না বলে ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি।
বিপিসি’র তথ্য বলছে, বিদেশি ছয় প্রতিষ্ঠান থেকে জ্বালানি তেল সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া সিঙ্গাপুরভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ নাগাদ বিপিসির কাছে প্রতিষ্ঠানটির পাওনা ছিল ২০২ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাওনা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) কাছে। সেখানে ঋণের কিস্তির পাওনা বকেয়া পড়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া, ইউনিপেক সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেডের কাছে বিপিসির কাছে পায় ৫৯ দশমিক ২৭ মিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়ার পিটি ভূমি ছিয়াক পোছাকো (বিএসপি) প্রায় ৪৭ মিলিয়ন ডলার, ভারতের ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল) প্রায় ৩৪ মিলিয়ন ডলার, পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল) পাবে প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার। আসছে সেপ্টেম্বর মাসে ২ লাখ ৬৫ হাজার টন ডিজেল, ৬৫ হাজার টন জেট ফুয়েল, ২৫ হাজার টন অকটেন এবং ৭৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে বিপিসির। কিন্তু বকেয়া পরিশোধ না হওয়ায় এখন পর্যন্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সরবরাহ নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
সবশেষ হালনাগাদকৃত তথ্য বলছে, আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে মজুদ ছিল ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭১ টন ডিজেল, ৫৬ হাজার ২৩২ টন জেট ফুয়েল, ৩৭ হাজার ১৭০ টন অকটেন, ২ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪ টন পেট্রোল এবং ৫৮ হাজার ৭৭৭ টন ফার্নেস অয়েল। ১৩ আগস্ট পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ তেলের মজুদ ছিল তা দিয়ে ৩৩ দিনের ডিজেল, ১৫ দিনের অকটেন ও ১৪ দিনের পেট্রোলের চাহিদা মেটানো সম্ভব। যদিও জ্বালানি তেলের নীতি বলছে দেশে ৬০ দিনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের মজুদ থাকার কথা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের তেলের মজুদ রাখা হতো। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ না নেয়া হলে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিতে পারে বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিপিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বকেয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকায় সরবরাহকারীরা এরইমধ্যে সামনের পার্সেলগুলো পাঠানোর ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করছেন। অন্যদিকে আইটিএফসির ঋণের কিস্তি শোধ করা না গেলে ক্রুড অয়েলের সংকট হতে পারে। তাতে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) প্ল্যান্ট বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশি সরবরাহকারীদের বকেয়া বিলের চাপ সামাল দিতে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ১৪ আগস্ট ভার্চুয়াল সভা করেন বিপিসি চেয়ারম্যান। বিপিসি সূত্রে পাওয়া তথ্য পলোচনা করে দেখা যায়, গত ১ এপ্রিল সোনালী ব্যাংকের ঋণপত্রের বিপরীতে অকটেনের একটি চালান সরবরাহ করে ভিটল এশিয়া। ওই চালানে অকটেনের মূল্য ২৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার। নিয়ম অনুযায়ী ২৮ এপ্রিলের মধ্যে মূল্য পরিশোধের কথা। কিন্তু গত ২৬ জুন থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ৬ কিস্তিতে ১১ দশমিক ০১ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে বিপিসি। ওই চালানের অবশিষ্ট বকেয়া ১৩ দশমিক ৬৬ মিলিয়ন ডলার। ওই পার্সেলের বিল পরিশোধের সময় পেরিয়েছে সাড়ে তিন মাস। গত ২৯ মে অগ্রণী ব্যাংকের আরেক এলসির বিপরীতে ডিজেলের একটি চালান সরবরাহ করে ভিটল এশিয়া। চালানটির জাহাজভাড়াসহ মূল্য ২৫ দশমিক ৩৪ মিলিয়ন ডলার। ওই চালানের বিল পরিশোধের নির্ধারিত মেয়াদ ছিল ৪ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ওই চালানের কোনো বিল পরিশোধ করতে পারেনি বিপিসি। ওআইসির সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আইটিএফসির ঋণ সহায়তায় ক্রুড অয়েল আমদানি করে। চলতি মাসে বিপিসির কাছে ঋণের কিস্তি বকেয়া পড়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার, যা পরিশোধ করা না গেলে পরবর্তী ক্রুড অয়েলের চালান আমদানি ব্যাহত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিপিসি সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির এক কর্মকর্তা বলেন, বকেয়া আদায়ের জন্য চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বহির্নোঙরে আসা জাহাজ থেকে জ্বালানি খালাস আটকে দিয়েছিল ভিটল এশিয়া এবং ইনোক। জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টদের ভাষায় তাকে ফিন্যান্সিয়াল হল্ট বলা হয়। পরে প্রতিষ্ঠান দুটির দেশি লোকাল এজেন্টের সঙ্গে বিল পরিশোধে আশ্বাস দেয়া হলে তারা ফিন্যান্সিয়াল হল্ট তুলে নেন। পরে জাহাজ দুটি থেকে জ্বালানি খালাস করা হয়। বিপিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি সরবরাহকারীদের পেমেন্ট নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তারা বলেন, বর্তমানে যে ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে, তার মধ্যে ভিটল এশিয়ার রয়েছে প্রায় ২২০ মিলিয়ন ডলার, আইটিএফসির ঋণের কিস্তি রয়েছে ১০৩ মিলিয়ন ডলার। পর্যন্ত নগদ অর্থ ব্যাংকে জমা থাকলেও শুধু ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক এলসির অর্থ পরিশোধ বিলম্বিত হচ্ছে। তবে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবি বিপিসি কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, জ্বালানি তেলের বিলের বকেয়া নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা চলছে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ