ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

আকস্মিক বন্যায় মহাবিপদ

প্রকাশনার সময়: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৫৯

বন্যা যদি ধীরলয়ে আসে মানুষের তবু একটা প্রস্তুতি নেয়ার সময় থাকে। এক রাতে যদি বাড়ি তলিয়ে উঠোন পেরিয়ে বসতবাড়ির মেঝে ছোঁয়— তার চেয়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় আর কিছু হতে পারে না। সবকিছু হঠাৎ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ করে দিতে হয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। অকার্যকর হয়ে গেছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। এমন এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে কোনো মানুষ কী বিপদে যে পড়েছে তা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানেন না। যে ঘরে আজ নতুন শিশু এসেছে সেই মায়ের কোমল আর্তনাদ, যে বয়োবৃদ্ধরা অসুস্থ তাদের দীর্ঘশ্বাস, অবুঝ ও অবোধ শিশুদের হঠাৎ নিরাশ্রয় হয়ে পড়ার ভয়াল কারুণ্য, গবাদিপশুর দুর্বিপাক; জাস্ট কল্পনা করা যাচ্ছে না। কত মানুষ কাঁদছে, কত হাজার মানুষ না খেয়ে ঘরের চালে বা গাছের শাখায় বসে আছে আমরা তার খবর কিছুই জানি না।

আমাদের জেনারেশন শিশুকালে ১৯৮৮’র বন্যা দেখেছি। চতুর্দিকে ঘোলাজলের দুর্বিপাকে সামান্য খাবার জলের সেকি সংকট। দু’মুঠো খাবার জোগাড়ে সেকি জীবনযুদ্ধ! বিচ্ছিন্ন জনপদে যারা বিপদে পড়েছেন তাদের বেদনা তারা ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারবে না।

আমাদের পূর্ব উত্তর সীমান্ত লাগোয়া ভারতের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এখনো যা চলমান আছে। কার্যত ভয়াবহ বন্যায় ধুঁকছে সেখানকার অধিবাসীরা। জল নিচে গড়ায় ওই নিয়মে আমরা যেহেতু নিচের বাসিন্দা আমাদের প্রাকৃতিক নিয়মে ওই বন্যার ধকল সইতে হবে। কিন্তু তাই বলে বাঁধে জমিয়ে রাখা পানি হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে আমাদের একরাতের মধ্যে ভাসিয়ে দিতে হবে এমন দুর্মর ব্যবহার তো আমরা বড় প্রতিবেশীর কাছে আশা করিনি। আমাদের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক টানাপড়েন আছে। তাই বলে সম্পর্ক তো এমন তলানিতে পৌঁছেনি যে, আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি বা মেনে নিয়েছি যে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের চলবে, কিংবা ভারতকে ছাড়াই বাংলাদেশ খুব ভালো থাকবে।

ডয়চে ভেলে জানাচ্ছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়ার তথ্য বাস্তবে সঠিক নয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতি নদীর অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট) এলাকায় কয়েক দিন ধরে এ বছর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। বাংলাদেশে এ বন্যা মূলত বাঁধের ভাটির দিকের বৃহৎ অববাহিকার পানির কারণে ঘটেছে।’

এই বিবৃতিতেও এক ধরনের দায় অস্বীকার করার প্রবণতা লক্ষ করা গেল। বাঁধের কারণে বন্যার খবর নাকচ করে দিয়েছে ভারত। এদিকে বাঁধ খুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভারত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে অসহযোগিতা করছে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম।

বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে হোক আর অতিবৃষ্টিতে হোক বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি এখন পানিতে তলিয়ে আছে, লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এটাই বাস্তবতা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আজ বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) এক তথ্য বিবরণীতে জানিয়েছে, বন্যায় আটটি জেলার প্রায় ২৯ লাখ মানুষ ক্ষত্রিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বন্যার পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানানো হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর সংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।

বিবিসি বাংলায় পরিবেশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ভারত থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা কয়েক দিনের ভারি বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী ও নোয়াখালীসহ দেশের আটটি জেলা। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের জায়গা দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করতে থাকায় একের পর এক জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ফেনীর বাসিন্দারা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, খাবার সংকট ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে লাখো মানুষ। কেবল ফেনীতেই সাড়ে ৩ লাখেরও বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সব ধরনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগ ও আতঙ্কে দিন কাটছে নিরাশ্রয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।

দুর্গত মানুষকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু এখনো তা খুব অপ্রতুল।

দ্য ডেইলি স্টার জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় ইতোমধ্যে ৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, নিখোঁজ আছেন আরো দুই জন। পূর্বাভাস বা আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই অন্তত ৩০ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছেন। ৪৩টি উপজেলার ৩৫৭ ইউনিয়নের সাড়ে চার লাখ পরিবার এখন ঘোরতর বিপর্যয়ে আছেন।

এবারের বন্যার সঙ্গে ভারতের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ভারতের বেশ কিছু মিডিয়া বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে নেতিবাচক শিরোনামে খবর পরিবেশন করেছে। জি ২৪ ঘণ্টা খুব উৎসাহ ও তাচ্ছিল্যভরে শিরোনাম করেছে, ‘ভারত ছাড়ল জল! হাবুডুবু খেতে খেতে বাংলাদেশের কাতর আর্জি!’ মানুষ প্রতিবেশীর প্রতি এমন অনুদার ও অসংবেদনশীল হয়? প্রতিবাদ জানানোর ভাষাও যেন আমরা হারিয়ে ফেলছি।

মানছি বৃষ্টি, বন্যা, বানভাসি ক্রাইসিস ঐশ্বরিক। কিন্তু নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ টোটালি প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিবিধির ওপর গুটিকয়েক অমানুষের অশুভ তৎপরতা। আমরা কথা বলব উজানবাসী ভারত কেন রাজনৈতিক বিবেচনায় হেডম দেখিয়ে নদীর পানি ইচ্ছামতো আটকাবে আর মনমতো যখন তখন ভাটিতে ছাড়বে?

বাস্তবতার নিরিখে মন্তব্য করবার সময় এসেছে, ‘এতদাঞ্চলের রাজনীতিকরা আর সুস্থ চিন্তার মানুষের কাতারে নেই’।

তবে সামষ্টিক ঘৃণা নয়, অহিংস গণমানুষকে ভালোবাসার মন নিয়ে প্রতিবেশী সাধারণ মানুষের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক ও সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে। যাতে ভৌগোলিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে সর্বমানুষের হূদ্যতাপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা যায়। আমরা কোথাও এক জন শিশুর কান্নাও আর দেখতে চাই না।

আমরা সবাই যেন দুর্গত মানুষের প্রতি আন্তরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হাতটা বাড়িয়ে দেই। মহান স্রষ্টা আমাদের সবার সহায় হোন এবং বন্যাদুর্গতদের ভয়াল দুর্ভোগ আশু লাঘব করুন।

আমরা চাই বড় প্রতিবেশী ভারত যেন পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের জনগণবিরোধী নীতি থেকে সরে আসে। বন্যার মতো অপরাপর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে দুই দেশ মিলে যেন যৌথ কমিশন গঠন করে। সম্পর্কের ক্রমাগত টানাপড়েন ও অবিশ্বাস দানা বাঁধতে দিলে এতদাঞ্চলের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করা যাবে না। আমরা প্রীতির হাত বাড়িয়ে দিতে চাই, তবে আন্তরিক সম্পর্ক বেগবান করার বড় দায় ভারতের এটা তাদের উপলব্ধি করতে হবে।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ