মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

বানভাসি ২৯ লাখ মানুষ

প্রকাশনার সময়: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৩৩

চলমান বন্যায় এখন পর্যন্ত দেশের আট জেলার ২৯ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং দুই জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল দুপুরে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৫০ উপজেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘দেশে আট জেলার চার লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ জন। মৃত লোক সংখ্যা দুই জন। এক জন ফেনীতে, আরেক জন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।’

পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫৩৪টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব আলী রেজা বলেন, ‘আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ৭৫ হাজার ৬৬৮ জন লোক এবং ৭ হাজার ৪৫৯টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য মোট ৪৪৪টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।’

দুর্গতদের জন্য নগদ ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে জানিয়ে কে এম আলী রেজা বলেন, ‘১৩ হাজার ৬৫০ টন চাল ও ১১ হাজার বস্তা শুকনা খাবার বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে।’

তিনি জানান, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে জেলা প্রশাসকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে; তথ্য ও সহযোগিতার জন্য ০২৫৫১০১১১৫ নম্বর চালু রয়েছে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ও; সহায়তার জন্য ফোন করা যাবে ০১৩১৮২৩৪৫৬০ নম্বরে।

বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিতে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। বিভিন্ন আবহাওয়া সংস্থার বরাতে সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃহস্পতিবার সকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাত কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরে উন্নতি হতে পারে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও কাছাকাছি উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা নদীর নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।

ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি সমতলে কমে যেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যুরো, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতাদের পাঠানো খবর—

ফেনী: ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে ফেনী।

জেলার তিন উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদে পানিবন্দি সাড়ে তিন লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বন্যাকবলিতরা বলছেন, ফেনীতে এমন ভয়াবহ বন্যা আগে দেখেনি কেউ। প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ফুলগাজী, পরশুরাম এবং ছাগলনাইয়া উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ, নেই বিদ্যুৎ সংযোগ। বেশির ভাগ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ডের ২৪টি বোট নিয়োজিত রয়েছে। তাদের পাশাপাশি বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দিয়েছেন। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে। বৃহস্পতিবার সকালে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। ফুলগাজী উপজেলার সদর ইউনিয়ন, আনন্দপুর, মুন্সীরহাট, আমজাদহাট ইউনিয়নের ৫০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পরশুরামের মির্জানগর, চিথলিয়া, বক্সমাহমুদ এবং পৌরশহরসহ অর্ধশতাধিক গ্রাম পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ছাগলনাইয়ার পাঠান নগর, রাধানগর, শুভপুর ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকটি গ্রাম বন্যাকবলিত। এসব এলাকায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, পুকুর ও ফসলি জমি। কিছু কিছু এলাকায় বানের পানি মানুষের ঘরের ছাদ ও টিনের চালও ছুঁয়েছে।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রায়হান মেহেবুব বলেন, ‘তিন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ, বেশির ভাগ এলাকায় পানির নিচে। এছাড়া ফেনী সদর, সোনাগাজী ও দাগনভূঁইয়া উপজেলার অনেক এলাকাও বন্যাকবলিত।’ তিন উপজেলায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, পানিবন্দি লোকজনকে উদ্ধারে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, স্থানীয় লোকজন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা কাজ করছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৩০ হাজারের মতো মানুষকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার কথা জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক। এছাড়া ফেনীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উঁচু ভবনকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান, ফেনী শহরেও পানি জমেছে। বেশির ভাগ উপজেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ নেই।

পরশুরামের মির্জানগর এলাকা থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ফেনী শহরের স্টেশন রোডের একটি হোটেলে এসে উঠেছেন ইসমাইল হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাতভর আতঙ্ক, মানুষের আর্তি আর বন্যার প্রবল বিধ্বংসী রূপ দেখেছি। প্রাণ বাঁচাতে ভিটেমাটি ছেড়ে সামান্য কয়েকটি কাপড়চোপড় সম্বল করে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হয়েছি।’

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবল থেকে লোকালয় রক্ষা করতে সোনাগাজী উপজেলার বড় ফেনী নদীর ওপর নির্মিত মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, জুলাই মাসের শুরুতে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর পানি বেড়ে ১৫ স্থানে ভাঙে। সেসব স্থানে জোড়াতালির মেরামতের পর চলতি মাসের শুরুতে বাঁধের আরও ১১ স্থানে ভেঙে গিয়ে প্লাবিত হয় ১০০টির বেশি গ্রাম। যেখানে অবকাঠামো, ধান, ফসল ও মাছের ক্ষতি ছাড়িয়ে যায় ৩০ কোটি টাকার বেশি। সেই ক্ষতি না পোষাতেই ১৫ দিনের মাথায় আবার বন্যা।

খাগড়াছড়ি : টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চরম বির্পযয়ের মুখে খাগড়াছড়ি। রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে প্লাবিত হয়েছে গ্রাম থেকে শহর। সম্প্রতিকালে খাগড়াছড়ি শহর না ডুবলেও বৃহস্পতিবার সকালে থেকে তাও প্লাবিত শুরু করেছে। পানি প্রবেশ করছে মেরুং ইউনিয়নের আশ্রয় কেন্দ্রেও। প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালার তিন ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি বাড়তে থাকায় এর মধ্যেই ডুবে গেছে জেলার বিভিন্ন সড়ক, কৃষি জমি ও পুকুর। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বুধবার খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পানি কমতে শুরু করায় আশ্রয় কেন্দ্র থাকা অনেক পরিবার বাড়ি ফিরতে শুরু করেছিল। তবে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। সকালেই শহরের ভেতরে প্রবেশ করে বন্যার পানি। আদালত সড়ক, মাস্টারপাড়া, মিলনপুর, বায়তুশরফসহ খাগড়াছড়ি পৌর শহরের সাতটি সড়ক এখন পানির নিচে। জেলা সদরের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ পানিবন্দি।

পৌর শহরের বাসিন্দা আরাফুলত ইসলাম বলেন, ‘এত পানি গত ১০ বছরেও দেখি নাই। শহরের মধ্যে সাধারণত পানি ওঠে না। এবার শহরের প্রধান সড়কগুলোও ডুবে গেছে।’ আরেক বাসিন্দা মাঈন উদ্দিন বলেন, টানা এক সপ্তাহের বৃষ্টি আর নদীর পানি বেড়ে পৌরসভার গঞ্জপাড়া, অপর্ণা চৌধুরী পাড়া, রাজ্যমণি পাড়া, কালাডেবা, বটতলী, ফুটবিল, শান্তিনগর, মুসলিম পাড়া পুরোপুরি পানির নিচে।

পাহাড়ি ঢলে হেডকোয়াটার এলাকায় দীঘিনালা-লংগদু সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালার মেরুং, বোয়ালখালি ও কবাখালি ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। ডুবে গেছে মেরুং বাজার। মেরুং ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। মাইনী নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এর মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রও ডোবা শুরু হয়েছে। মেরুং বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রের নিচতলা ডুবে গেছে। সেখানে আশ্রয় নেয়া ২৯টি পরিবারকে বিদ্যালয় ভবনে দ্বিতীয় তলায় তুলে দেয়া হয়েছে।’ খাগড়াছড়ির প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। এদিকে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে তিন দিন ধরে রান্না করা খাবার বিতরণ করছে জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা। জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান জানান, খাগড়াছড়ি পৌরসভায় ১৮টিসহ পুরো জেলায় ৯৯টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রাখা হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মৌলভীবাজার: মৌলভীবাজারে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। গত তিন দিনে জেলার সাত উপজেলায় ৩৭টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার মানুষ বন্যা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ফলে বড়লেখা, জুড়ি, রাজনগর, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ, রাজনগর, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ২১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোররাতে জেলার রাজনগর উপজেলার কদমহাটা এলাকায় মনু নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। ফলে ভোররাত থেকে মৌলভীবাজার-রাজনগর-ফেঞ্চুগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার-কুলাউড়া-বড়লেখা সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে, গত বুধবার রাতে কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানে ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। বন্যাক্রান্ত এসব এলাকার লোকজন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। তবে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের লোকজন খোঁজ না নেয়ায় চরম খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, সাত উপজেলায় বন্যাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক লাখ ২২ হাজার ৬৮৭ জন এবং ১৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ হাজার ৩২৫ জন। পৌরসভা ও ইউনিয়ন মিলে ৩৭টি এলাকায় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে ২১২টি গ্রাম। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৩৫ টন চাল এবং ৭ উপজেলায় ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, জেলার জুড়ী নদে ১৯৩ সেন্টিমিটার, ধলাই নদে ৩০ সেন্টিমিটার, মনু নদীতে চাঁদনীঘাটে ১১৮ সেন্টিমিটার ও রেলওয়ে ব্রিজে ৮৫ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া মৌলভীবাজার শেরপুর পয়েন্টে কুশিয়ারা নদী পানি বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম: ফেনী ও কুমিল্লার বিভিন্ন স্থানে রেললাইন পানিতে ডুবে গেছে। এ ছাড়া রেল সেতুর ওপর দিয়েও পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুটি ট্রেন ছেড়ে গেলেও গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় দুপুরের পর থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলাচলরত আন্তঃনগরসহ সব ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। জানা গেছে, চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বন্যার কারণে ট্রেনগুলো গন্তব্যে যেতে পারেনি। ফেনী থেকে ফাজিলপুর পর্যন্ত রেললাইন পানিতে ডুবে গেছে। বন্যার পানিতে কুমিল্লায় রেললাইন উপড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফেনী স্টেশনে বন্যার পানি জমে রয়েছে। রেলওয়ের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ফেনীতে রেললাইন ও রেলসেতুর ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই অবস্থা হয়েছে সিলেটের একটি রেল সেতুতেও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনেও পাহাড় ধস হয়েছে। এ অবস্থায় ট্রেন চালানো খুবই বিপজ্জনক। তাই যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং রেলের সম্পদ রক্ষায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সিলেট: সিলেটে অতিবৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বিপৎসীমা ছাড়িয়ে গেছে সিলেটের কুশিয়ারা নদীর পানি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) দেওয়া তথ্যমতে এমনটি জানা যায়। পাউবো জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কুশিয়ারার চারটি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিন সকাল ৯টায় কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে, গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় এ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। এছাড়া গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় কুশিয়ারার পানি শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৭১ ও শেরপুর পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত বুধবারও এই নদীর তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপরে ছিল। এদিকে, ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের সঙ্গে সিলেটে অব্যাহত রয়েছে বৃষ্টিপাতও।

লক্ষ্মীপুর: অতিভারি বৃষ্টিপাতে তালিয়ে গেছে লক্ষ্মীপুরের পাঁচটি উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা। গত কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের পানি নামতে না পারায় বাড়ির উঠান, মাঠ-ঘাট, পুকুর, জলাশয়, ফসলি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কারো কারো ঘরেও পানি ঢুকে পড়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন অনেকে। গবাদিপশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন বন্যাদুর্গতরা। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছচাষিরা। জেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা ছোট-বড় প্রায় সব খালেই অবৈধ বাঁধ এবং দখলদারের কবলে পড়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের হিসাব মতে, জেলাতে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। তবে কেউ এখনো কোনো আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেনি। জেলায় ১৮৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এদিকে বৃষ্টির পানি মেঘনায় নেমে যেতে জেলার ছোট-বড় সবগুলো স্লুইস গেট খুলে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। লক্ষ্মীপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে লক্ষ্মীপুরের সবগুলো স্লুইস গেট খুলে দেয়া হয়েছে। আমাদের কর্মীরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন। মেঘনা নদীতে ভাটা পড়ার সময় স্লুইস গেট দিয়ে খালের পানি নদীতে নেমে যাচ্ছে। নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চতা বাড়লে গেট বন্ধ করে দেয়া হবে।

বন্যার তথ্য সংগ্রহে কন্ট্রোল রুম চালু : দেশে চলমান বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে কন্ট্রোল রুম খুলেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কন্ট্রোল রুমের মোবাইল নম্বর-০১৩১৮২৩৪৫৬০। সার্বিক বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসেবে মনিটরিং করবেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রবিউল আলম (মোবাইল: ০১৯৯২৪৩৯৩৪৭) দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা চলমান বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলায় স্থাপিত কন্ট্রোল রুম ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এ বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করেবন। এছাড়া সমন্বিত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রতিবেদন জমা দেবেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। আকস্মিক বন্যায় দেশের ৯টি জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত এসব জেলা হলো ফেনী, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও খাগড়াছড়ি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘রেসকিউ ও ত্রাণ বিতরণ’ কর্মসূচি: নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যাকবলিতদের পাশে দাঁড়াতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সারা দেশে রেসকিউ অপারেশন ও ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি পালন করবে তারা। গত বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদারের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ভারত থেকে আসা উজানের নদীগুলোর বাঁধ খুলে দেয়ায় নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, মৌলভীবাজার, সিলেট ও খাগড়াছড়িসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাগুলো পাহাড়ি ঢল ও বন্যার কবলে পড়েছে। একই সঙ্গে, দেশের উত্তরাঞ্চলেও বন্যার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সারা দেশে রেসকিউ অপারেশন এবং ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী দল গঠনের আহ্বান জানিয়ে এতে আরো বলা হয়, এ কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ একটি পাবলিক ফান্ড রেইজিং উদ্যোগ শুরু করছে। সব ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং ভলান্টিয়ারদের আহ্বান জানানো হচ্ছে, আপনারা নিজ নিজ জেলা-উপজেলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং জনসাধারণের সঙ্গে সমন্বয় করে স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করুন। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল আপনাদের সঙ্গে সমন্বয় করে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের জন্য রেসকিউ অপারেশন ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এতে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়, নিজ নিজ এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একাধিক হটলাইন নম্বর চালু করুন এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করুন। নিকটস্থ নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলো চিহ্নিত করে তা সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষদের জানিয়ে দিন।

অসহায়-দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান ওয়ার্কার্স পার্টির: বন্যাদুর্গত প্রত্যেকটি জেলায় ত্রাণ তৎপরতা শুরু এবং কবলিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটি কেন্দ্রীয়ভাবে তোপখানা রোড থেকে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলেও জানানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় চিকিৎসা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির ভার্চুয়াল এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় কুমিল্লা-ফেনী-নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লাখ লাখ মানুষের ভয়বাহ বন্যায় আক্রান্ত হওয়াতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওয়ার্কার্স পার্টি। বন্যাকবলিত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করার নির্দেশ: পাহাড়ি ঢল আর ভারি বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করার নির্দেশ দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আশরোফা ইমদাদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বরাত দিয়ে জানানো হয়, বন্যাদুর্গত এলাকার ১৩ শতাংশ সাইট ডাউন রয়েছে। কয়েকটি উপজেলায় অপটিক্যাল ফাইবার ড্যামেজ হওয়ার কারণে নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়েছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছে কয়েকটি জায়গা। সেসব জায়গায় জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, নেটওয়ার্ক একবারে বিচ্ছিন্ন হলে ১০টি ভিএসএটি প্রস্তুত আছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ফ্রি করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত ২১ আগস্ট থেকে আকস্মিক বন্যায় দেশের ৯টি জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত এসব জেলা হলো ফেনী, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর ও খাগড়াছড়ি।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ