বিদ্যুৎ খাত এগিয়ে নেয়ার ধোঁয়া তুলে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। অভিযোগ আসছে টাকা অপব্যবহারের। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন শেখ হাসিনা সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু’র নাম। দুদকে অভিযোগ এসেছে টানা ১০ বছর প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতায় থাকাকালে অবৈধভাবে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। বিদ্যুৎ খাতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিদ্যুৎ বিভাগের অন্তত পঞ্চাশ জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি করে অবৈধ অর্থ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।
ডিপিডিসির প্রভাবশালী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা। ২০১৫ সালে তিনি নির্বাহী পরিচালক (অর্থ) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। গেল দশ বছর বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কল্যাণে কয়েক দফায় তার চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ বেড়েছে। আজ পর্যন্ত তিনি স্বপদে বহাল রয়েছেন। দুদকে করা অভিযোগে বলা হয় রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় তিনি একাধিক বহুতল ভবন করেছেন এবং গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতেও নামে-বেনামে করেছেন অনেক সম্পদ।
আবার এ বছরের শুরুতে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের পিজিসিবি’র একটি প্রকল্পের পরিচালক পদে থাকা প্রকৌশলী কিউএম শফিকুল ইসলামকে ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) পদে নিয়োগ দেয়া হয়। দুদকে করা অভিযোগে বলা হয় বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে একজন সিনিয়র সচিব তাকে এ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তিনি ডিপিডিসিতে বদলি, পদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্য করছেন। অপরদিকে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের বিরুদ্ধে সংযোগ প্রদানে হয়রানি ও ঘুষ লেনদেনের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। আর এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার বিশ্বস্ত সিপাহশালার হিসেবে কাজ করেন ডেসকো’র বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান (স্বাধীন)। এ স্বাধীন প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলের অধিকাংশ অবৈধ লেনদেন এবং গ্রাহকের সঙ্গে অনৈতিক চুক্তি করেন বলে অভিযোগে প্রকাশ। এর আগের এদের দুর্নীতির কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলেও প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডল তার প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান (স্বাধীন) কে ব্যবহার করেছে।
জানা যায়, প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে ২০০৫ সালের দিকে ডেসকোতে সহকারী প্রকৌশলী পদে জোগদান করেন। পরবর্তিতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ থেকে ডেসকো কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ২০১৪ সালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে প্রধান প্রকৌশলীর পদ বাগিয়ে নেন। এরপর ২০১৫ সালে তৎকালীন ডেসকো বোর্ড পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশে প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডলকে ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) নিয়োগ দেয় বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
সব অভিযোগের ব্যাপারে শিগগিরই গোয়েন্দা কার্যক্রম শুরু হবে জানিয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আসলে কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং চলমান আছে। এ ধরনের অভিযোগগুলো অবশ্যই আমলে নেয়া হবে এবং যথানিয়মে তদন্ত কিংবা অনুসন্ধান যেটা প্রয়োজন সেটা করা হবে। এ ধরনের অভিযোগ অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া হবে।দুদকে দায়েরকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে করা সম্ভাব্য তালিকায় রয়েছেন, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. কাওসার আমীর আলী, ডেসকো’র নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) প্রকৌশলী জগদীশ চন্দ্র মন্ডল, নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌ. মো. জাকির হোসেন, ডেসকো’র বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশল পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান (স্বাধীন), পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাং সেলিম উদ্দিন, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান এএসএম আলমগীর কবির, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) প্রধান প্রকৌশলী (এস.ও এবং স্ক্যাডা) মোহাম্মদ শাহেদ মাহবুব ভুঁইয়া, প্রধান প্রকৌশলী (সেন্ট্রাল) মো. জাহাঙ্গীর আলম, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী (ধানমন্ডি অঞ্চল) আ আ ম মোস্তফা কামাল, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিং) শ্রীবাস চন্দ্র বিশ্বাস, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এস.সি এবং স্ক্যাডা) মো. আব্দুর রাজ্জাক, বংশাল ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. মাহবুব হোসেন, কামরাঙ্গীরচর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এহসানুজ্জামান, জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদী, শীতলক্ষা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. গোলাম মোর্শেদ, জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তারিকুল ইসলাম টিটু, জিটুজি প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়েজ করিম, কাজলা ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল ইসলাম, ফতুল্লা ডিভিশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সানোয়ার হোসেন, শীতলক্ষা ডিভিশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহবুব আলম মোল্লা, শ্যামপুর ডিভিশনের সহকারী প্রকৌশলী মো. আকরাম হোসেন, ডিপিডিসি’র বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশল সমিতির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও পোস্তগোলা ডিভিশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহাদাৎ হোসেন, সাবেক নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) হারুন অর রশিদসহ ডিপিডিসি, ডেসকো, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং পিডিবি’র সাবেক ও বর্তমান আরো অনেকের নাম রয়েছে এই তালিকায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ’র (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রশাসনিক পদক্ষেপের পরিবর্তে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বদলি বা অবসরের মতো প্রশাসনিক পদক্ষেপ আশাব্যঞ্জক মনে হলেও তাতে দুর্নীতির মূল কারণগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না।’ তিনি বলেন, বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ অর্জনের উৎস ও সূত্রগুলো চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত হলে সে যত বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হোক না কেন তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান। দুর্নীতির অভিযোগে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর যথেষ্ট নয়। ক্ষেত্রবিশেষে তা দুর্নীতিকে উৎসাহ দেয় এবং অজান্তেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালন করতে পারে বলে মন্তব্য করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ