ঢাকা, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে

প্রকাশনার সময়: ২১ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৩৬

বাংলাদেশে সরকার পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েকদিন ধরে যে শূন্যতা, সেটির অবসান হলো ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তবে শুরু থেকেই নতুন এ সরকারকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে জনজীবনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশ নেয়ার পেছনে সেটাও একটা বড় কারণ বলেই উঠে এসেছে। দেশটির রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণআস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। দুই-তিন মাসের মধ্যেই অর্থনীতির কিছু বিষয়ে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি ৪-৫ মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে নামিয়ে আনতে হবে। মুদ্রা বিনিময় হারকে স্বাভাবিক করতে হবে, রিজার্ভ একটু বাড়াতে হবে। এগুলো দ্রুত করতে হবে। মানুষকে দ্রুত কিছু রেজাল্ট দেখাতে হবে। পশ্চিমের অনেক দেশই ছয় মাসের মধ্যেই ইনফ্লেশন দশ-বারো শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদের এখানেও সম্ভব। আমরা এতদিন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি বলেই হয়নি। এখানে মুদ্রার হার বাজার ভিত্তিক রাখতে হবে, টাকা ছাপিয়ে সরকারের ব্যয় মেটানো যাবে না, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেয়া যাবে না। এগুলো যদি করতে পারে এবং বিদেশি সহায়তা পায় তাহলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে বাধ্য। সরকার পতনের পর ঢাকার প্রায় সব থানা থেকে সরে যায় পুলিশ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা।

মূলত আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা, গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে বহু মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার থানায় উত্তেজিত জনতার হামলায় পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাও আছে। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট এখন প্রকট। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। এখানে এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং জনগণ-কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দু’পক্ষই অনিরাপদ বোধ করছে। এ জায়গায় একটা বিশ্বাস এবং আস্থা খুব দ্রুতই তৈরি করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে যে দুর্নীতি, নির্যাতনের সংস্কৃতি এবং জনগণের সেবা না পাওয়ার ইতিহাস সেটা বদলাতে হবে। কোনো অনিয়ম হলে সেটার প্রতিকার যদি হয়, তাহলে মানুষের আস্থা ফিরবে। এক্ষেত্রে আগে সরকারের মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। সরকার এলে এসব বাহিনীকে ব্যবহার করে। সুতরাং সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব পরিবর্তন হলে বাহিনীর ভেতরেও সংস্কার আসবে। এসব বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার উপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের আগেই এসব বিষয়ে এখন সংস্কারের তাগাদা দিয়েছেন অনেক বিশ্লেষক। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই এখন কমবেশি সংস্কার করতে হবে। দেশে দুর্নীতি বড় সমস্যা। সুতরাং দুর্নীতি দমন কমিশনের কী হবে, বিচার বিভাগের কী সংস্কার হবে, র‍্যাব থাকবে কি না এরকম অনেক বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে।

অন্যদিকে সাংবিধানিক যত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেভাবে সংস্কার করতে হবে। তাহলে সেটা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে দুর্নীতির মতো কাজ থেকে দূরে রাখবে। অতীতে কিন্তু এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। যদিও নতুন এ সরকার এমন সময়ে দায়িত্ব নিচ্ছে যখন দেশে ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রশাসন এবং অন্যান্য সেক্টরেও চলছে অস্থিরতা। আছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। এর সঙ্গে আছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশা। কিন্তু সব মিলিয়ে নতুন সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা। শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজ যেসব রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু এর মধ্যেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যেই ঢাকায় মাঠে নেমে সমাবেশও করেছে বিএনপি। দলটি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে বলেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবিলায় তিন মাস যথেষ্ট নয় বলেই আলোচনায় উঠে এসেছে। স্বল্প সময়ের জন্য কোনো সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবে না। আর সংস্কার না হলে সেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে কি পারবে না। এ প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তবে যত দ্রুত সম্ভব দেশে একটি নির্বাচন ব্যবস্থার আয়োজন করাও বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ হওয়ার বিপক্ষেও যুক্তি আছে। কারণ এ সরকার নির্বাচিত নয় এবং নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দলও নেই। এখানে ঢালাওভাবে দুই থেকে তিন বছর সময় নিয়ে সংস্কার করব এরকম একটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম।

আবার তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক দলগুলো চায় বলেই নির্বাচন দিতে হবে সেটা করাও নতুন সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ভাবে তৈরি করতে যে সময় দরকার সেটাই নিতে হবে। দীর্ঘ সময় লাগলে সেটা দেশেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সব মিলিয়ে সরকারের সামনে বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জ এখন সামনে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নতুন সরকারকে এগুতে হবে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, নতুন যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে, তাকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। গণবিক্ষোভে রূপ নেয়া ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে দেশটির জন্য সামনের দিনগুলো সহজ হবে না। গত ৫ আগস্ট সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার নতুন যে সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্বে রয়েছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ৮৪ বছর বয়সি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হবে বেসামরিক নেতৃত্বে। তবে এ সরকারে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও এ সরকারে সামরিক নেতৃত্বের বড় প্রভাব থাকবে। মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশের অনেকে আশঙ্কা করছেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হয়, তাহলে তাতে সরকারে নিজেদের কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করার সুযোগ পাবে সেনাবাহিনী। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী সরকারে সক্রিয় ভূমিকা ও রাজনীতির কেন্দ্রে থাকার বিষয়ে অতটা আগ্রহী নয়, যেমনটা কয়েক দশক আগেও দেখা গিয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনে চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর তার মিত্রদের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা হচ্ছে। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ জানাচ্ছে মানবাধিকার গোষ্ঠী ও কূটনীতিকরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের স্মৃতি সিংহ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ তৈরি করে দেয়া। একই সঙ্গে নতুন করে যাতে আর কোনো সহিংসতার ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সরকারকে সহযোগিতা করে, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত শান্ত হয়ে আসবে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু এর পরও দেশটিতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পাননি। সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশটির পোশাক খাতকে বড় একটি নাড়া দিয়েছে। সহিংসতার সময় পোশাক কারখানাগুলো বন্ধ ছিল। বাংলাদেশে পোশাক কারখানা আছে সাড়ে তিন হাজার। দেশটির বার্ষিক সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক অস্থিরতার মধ্যে মার্কিন প্রতিষ্ঠান হুলা গ্লোবাল জানিয়েছে, কিছু ক্রয়াদেশ বাংলাদেশের বদলে অন্য দেশে দিয়েছে তারা। এসব বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে। গত জানুয়ারির যে নির্বাচনে শেখ হাসিনা পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হন, সেই নির্বাচন ছিল বেশির ভাগ মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য। প্রধান বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছিল।

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক টমাস কিনের মতে, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ যে ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল, তার একটি বড় কারণ এটি। কারণ গত ১৫ বছরে দেশটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদে কাজ শুরু করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটিতে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে কাজ শুরু করবে বলে আশা করছি এবং নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হবে। যেই ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে মানুষের। একই সঙ্গে সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। ক্রাইসিস গ্রুপের টমাস কিন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেয়ার মতো দায়িত্ব নিতে হবে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। তবে, ছাত্র-জনতাসহ দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, সবাই উদ্ভূত পরিস্থিতি ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা এবং নতুন সরকারকে সহযোগিতা করুন।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ