বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘টাকা পাচার’। বিগত সরকারের আমলে সরকার সংশ্লিষ্ট কে কত টাকা বিদেশে পাচার করেছেন সেসব তথ্য এখন জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যম বিশেষ করে গণমাধ্যমে প্রতিদিনই এসব তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। যদিও সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও এসব অভিযোগ উঠেছিল। তখন তারা এসব স্বীকার করেননি। আবার এ ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণপত্রও কারো কাছে ছিল না। শুধু মুখের কথায় তো জনমত তৈরি করা যায় না। সে সময় কোনো কিছু স্পষ্ট জানার সুযোগ না থাকলেও এখন অনেকেই নির্ভয়ে সব খবর প্রকাশ করছে। এসব জেনে আমরা ব্যথিত হচ্ছি। কারণ এগুলো আমাদের কষ্টার্জিত টাকা। এ দেশের জনগণের টাকা, যা ভোগ করার অধিকার শুধু এই দেশের মানুষেরই আছে। এই টাকা পাচারের সঙ্গে বিশেষ শ্রেণীর কোনো ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠী জড়িত, সে ব্যাপারে আমরা এতদিন অনুমান করলেও এখন ধীরে ধীরে সব স্পষ্ট হচ্ছে।
আমাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী দেশের টাকা অন্য কোনো দেশে পাঠানো যায় না। নির্দিষ্ট কতগুলো খাত ছাড়া টাকা পাঠালে তা পাচার বলে গণ্য হবে এবং তা আইনত অপরাধ। তবুও কীভাবে এত টাকা বাইরে পাচার হলো? উদাহরণ দিয়ে বলি- আমার একটা পাওয়ার প্লান্ট আছে, এই প্লান্টের কাঁচামাল হলো HFO (heavy farnese oil)। এই জ্বালানি আমি hfo সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে, ধরুন- shell কোম্পানির কাছ থেকে পার টন একটা নির্দিষ্ট দাম ধরে কিনলাম, এরপর আমি বিদেশে আমার একটা কোম্পানি ও অফশোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, খুলে পার টন ৫০ ডলার বেশি উল্লেখ করে ইনভয়েস করে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার পাঠাতে পারি। সাধারণত ১ চালানে ২৫০০০ টনের মতো HFO অতিরিক্ত টাকা পাঠানো গেল প্রায় ৭৫০০০০ ডলার, বাজার মূল্যে প্রায় ১০ কোটি টাকার মতো। এখানে কেউ কিন্তু বেআইনি কিছু করেনি। সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে অতিরিক্ত টাকা দিয়েছে, পাবলিক মানি থেকে। সরকারের অলিগার্ক বা সুবিধাভোগীরা মূলত এভাবেই আইনকে ফাঁকি দিয়ে টাকাগুলো বাইরে নিয়ে গেছে।
এভাবেই সামিটের মালিক সিঙ্গাপুরের শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছে। বিএনপির লেবাস পরা ইউনাইটেড গ্রুপ পুরোদমে ব্যবসায়িক লাভ করে। অথচ অভিযোগ রয়েছে, বেগম খালেদা জিয়াকে অসুস্থ অবস্থায় ইউনাইটেড হাসপাতাল থেকে ন্যূনতম ওষুধ সরবরাহ করা হয়নি। একই পলিসি ফলো হয়েছে, গার্মেন্টস রিলেটেড ব্যবসাগুলোতেও। এর বাইরে পুলিশ, কাস্টম ও এনবিআরের যেসব কর্মকর্তার দুর্নীতি প্রকাশ করা হচ্ছে তা আসলে ব্যক্তি পর্যায়ে। দেশের বিপুল পরিমাণ টাকা বাইরে পাঠানোর সময় যারা জড়িত থাকে তাদের- যারা হালকা উচ্ছিষ্টভোগী। এমনকি ব্যাংকিং চ্যানেলেও যারা টাকা লোন নিয়েছেন তারাও ওভার বা আন্ডার ভয়েসিংয়ের মাধ্যমে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকা বা অন্য কোনো দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। প্রশ্ন হলো সেই পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনা কতটা কঠিন? অনেকেই মনে করেন এটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ, সুতরাং এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ সময় ও শ্রমের অপচয় (এরকম ধারণাই বিগত সরকারের আমলে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে)। আমি যেহেতু এ বিষয়ে একেবারেই অনভিজ্ঞ, তাই এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য না করে, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের ঠিক দুই বছর আগে জাতীয় দৈনিকে (যুগান্তর) প্রকাশিত বক্তব্যের রেফারেন্স দিচ্ছি- “পাচারের টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আগে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা হবে কিনা। এ সিদ্ধান্ত হলে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে আইনি কাঠামো আছে, তাতে টাকা ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন কিছু নয়। তবে একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কারো টাকা ফিরিয়ে আনা হলে পরে আর কেউ টাকা পাচার করতে সাহস দেখাবে না।’’
তিনি আরও বলেন, “সুইস ব্যাংক এখন বিভিন্ন দেশকে তথ্য দিচ্ছে। এ জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তথ্য চাইতে হবে। তা না হলে তথ্য পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত তাদের দেশের আইন অনুসরণ করে কোনো তথ্য চায়নি। ফলে তারা তথ্য দিচ্ছে না।”
মূলত দুই বছর আগে ঢাকায় তৎকালীন সুইস রাষ্ট্রদূতের সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠানে, তার কিছু বক্তব্যের পর এ বিষয়ে কিছু পত্রিকা লেখালেখি করে। পরবর্তীতে এ নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আলোচনা হলেও তা খুব একটা কোথাও প্রভাব ফেলেনি। সরকারের তরফ থেকে কথা বলা ছাড়া এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ন্যূনতম কোনো সদিচ্ছা ছিল না। সাংবাদিকদের ওপরও হয়তো চাপ ছিল, এ রকম বিষয়ে আর যেন গুরুত্বসহকারে কোনো রিপোর্ট না হয়, যাতে জনমত এ ধারণা নিয়ে থাকে যে বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং এ বিষয়ে সরকারের কিছুই করণীয় নেই।
পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রথম পদক্ষেপ হলো, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য সংগ্রহ করা। যে তথ্য একমাত্র সরকারের পক্ষেই অফিসিয়ালি সংগ্রহ করা সম্ভব (কারণ তথ্য পেতে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে হয়, যেমন: Common Reporting Standards(CRS) চুক্তি- যেটাতে ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপসহ ১২১টি দেশ সই করলেও বাংলাদেশ করেনি, স্পষ্টতই সদিচ্ছার অভাব ছিল। এছাড়া কিছু আন্তর্জাতিক গ্রুপ বা ফোরামে যুক্ত থাকা, যেমন: Automatic Exchange of Information (AEOI) এর সদস্য হওয়া, এখানেও বাংলাদেশ অনুপস্থিত)। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে (বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, দুদক, গোয়েন্দা সংস্থা ইত্যাদি) সম্মিলিতভাবে এ জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ও একযোগে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি কমিটেড কিছু এক্সপার্টকে রাখতে হবে, যাতে ইনফরমেশন ও তদন্ত নিয়ে সচ্ছতা ও জনতার সঙ্গে সেতুবন্ধন তৈরি হয়। সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও প্রয়োজনীয় তথ্যসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যোগাযোগ করে তাদের পাচারকৃত অর্থের বর্তমান গন্তব্য ও পরিমাণের তথ্য জানতে হবে। পাচারকৃত অর্থ যে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ বা অবৈধ অর্থ (যেহেতু সংশ্লিষ্টদের আয়ের সঙ্গে তা সংগতিহীন; এটা প্রমাণ করা কঠিন কিছ ুনা) তার প্রমাণসহ পাচারের গন্তব্যস্থল দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তা ফেরত আনা সম্ভব। বিগত সরকারের আমলেই বিরোধী একজন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পাচারকৃত অর্থের কিছু অংশ সিঙ্গাপুর থেকে এভাবে ফেরত আনার উদাহরণ রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি পাচারকৃত সব অর্থ কোনো কারণে ফেরত আনা সম্ভব না হয়, তবে অন্ততপক্ষে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তথ্য জনগণের সামনে প্রকাশ করে, তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বয়কটের উদ্যোগ অন্তত নেয়া যায়।
বোঝা যাচ্ছে, টাকা ফিরিয়ে আনা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু না। তবে সময়সাপেক্ষ এবং এর জন্য প্রধানত যেটা জরুরি, তা হলো এ বিষয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার সেই সদিচ্ছা যথেষ্টই আছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত বর্তমান গভর্নরও এ বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে সরকারের করণীয় বিষয়ে নিজের মতামত/পরামর্শ ব্যক্ত করেছেন। কাজেই আমরা আশাবাদী, উনারা তাদের সদিচ্ছাকে অবশ্যই কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।
আপনারা হয়তো জেনে অবাক হবেন, বিদ্যুৎ এ আমরা আমাদের দেশের চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন করি। কিন্তু আমাদের মূল সমস্যা ডিস্ট্রিবিউশনে। এ সমস্যা পুঁজি করে, পিডিবি কতিপয় মানুষের কাছ থেকেই বিদ্যুৎ কেনে ও তাদের বিল প্রদান করে থাকে, মানে ব্যবসার ভিতরেও চাঁদাবাজি চালু করেছে। আর আগের সরকারের করা অনেকগুলো পাওয়ায় প্লান্টের কাজ এখনো চলমান, যেগুলো বানানোর টাকাও আপনার-আমার পকেট থেকেই নেয়া হবে। কাজেই এখনই আওয়াজ তুলুন, যাতে বিগত সরকারের সময় করা সব চুক্তি ও কাজ দৃশ্যমান হয় ও জনতা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এই টাকাগুলোর কারণে আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কিছু কথায় প্রকাশ করা যায়। কোন কথাগুলো জানেন?
১.পানি লাগবে কারো পানি পানি/২.ভাইয়া আমি কি মারা যাবো/৩.আল্লাহর কসম আঙ্কেল আমি কিচ্ছু করিনি/৪.বাবা এখন কোথায় জানো? হ্যাঁ! মারা গেছে/৫.আমাকে যাইতে দেন না আমার ছোট একটা বোন আছে/৬.আংকেল আমার মা-বাবা কেউ নাই আমার ছোট বোনটাকে ঘরে তালা দিয়ে আসছি/৭.আংকেল গেইট -টা খুলেন আমাদের মেরে ফেলবে/৮.আমার বাবা নাই বাড়িতে আমার ছোট একটা বোন আছে! আমার বোনটাকে আপনারা একটু দেখে রাইখেন। এই লাইনগুলো প্রতি রাতে কানে বাজবে, আর আমাদের কাঁদাবে।
লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও সাবেক সেনা সদস্য
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ