সরকারের ভুল অর্থনৈতিক নীতি, দুর্নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সুশাসনের ঘাটতি, বিশেষ গোষ্ঠী প্রীতি, একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতাসহ নানা কারণে দেশে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। শত চেষ্টা করেও ডলার সংকট কাটানো যায়নি। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত আছে তার সঠিক তথ্য দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের সরকার পতনের পর শিক্ষার্থীদের মনোনীত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আন্দোলন চলাকালীন অর্থনৈতিক সংকট আরো বেড়েছে। ফলে সংকট উত্তরণে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে ধাপে ধাপে যথাযথ পরিবর্তন আনার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। তারা বলেন, অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ করতে হবে ধাপে ধাপে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও নির্বাচিত সরকারের দীর্ঘদিন ধরে একনায়ক হয়ে ওঠার কারণে সংকট ঘনীভূত হয়েছে। রাজনীতিবিদরা তাদের বাজে সিদ্ধান্তগুলো নেয়ার আগে কোনো রকম আলোচনা করেননি। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কোনো ধরনের ভারসাম্য ছিল না। তাই এ সংকট থেকে উত্তরণ করতে হলে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনতে হবে।
বর্তমানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হবে। তবে এ জন্য কঠোর নীতি বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এমনকি চরম অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কাসহ অধিকাংশ দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশের ভোক্তা মূল্যসূচক (সিপিআই) বেড়েই চলেছে।
গত বছরের মার্চ থেকে দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ঘোরাফেরা করলেও দুটি প্রধান কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রথমটি হলো কার্যকর উদ্যোগ নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক দেরি করেছে। অন্যটি হলো চলতি বছরের ৮ মে পর্যন্ত বিভিন্ন আকারে বহাল থাকা সুদের হারের ঊর্ধ্বসীমা সরকারের মুদ্রানীতিকে অকার্যকর করে তোলে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ, মহামারি-পরবর্তী প্রণোদনা প্যাকেজ ও কিছু দুর্বল ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিতে নতুন অর্থের জোগান দিয়েছে। এগুলো দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।
তবে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা হলো— আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির জন্য কিছু সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কারমূলক উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সুদহারের সীমা বাতিল করা ও সুদহার বাজারভিত্তিক করা।
এদিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেয়া কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগটি এই অর্থবছরের বাজেটে দেয়া আছে, সেটি বাতিল করা হোক। এ বিষয়ে তিনি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তবে একই সঙ্গে তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আয়কর ৩০ শতাংশের সঙ্গে ৫ থেকে ১০ শতাংশ জরিমানা যোগ করে সীমিত সময়ের (৩ থেকে ৬ মাস) জন্য এ সুযোগ পুনর্বহাল করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
তাছাড়া বিশ্ববাজারে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ার আগেই কলকারখানায় উৎপাদনে ফেরার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতি হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কর্মসংস্থানও। সব মিলিয়ে সারা দেশে আতঙ্কের মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা আমরা চাই না। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতির স্বার্থে পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া উচিত।’
দেশে চলমান সংকটের মধ্যে মূল্যস্ফীতি অন্যতম। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি একটি শক্তিশালী মুদ্রানীতি গ্রহণ করে, বাণিজ্যিক ব্যাংককে অতিরিক্ত তারল্য সহায়তা প্রদান করা থেকে বিরত থাকে এবং বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থ না ছাপায়, তাহলে আগামী ছয়-নয় মাসের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির হার কমতে শুরু করবে বলে মনে অনেক অর্থনীতিবিদ। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার বলেন, ‘কঠোর মুদ্রানীতি সব প্রধান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার দ্রুত হ্রাসে অবদান রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি নতুন করে টাকা না ছাপায় তাহলে বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির হার ৫-৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি রোধে আর বিলম্ব না করে পলিসি রেট বর্তমান সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে কমপক্ষে ১০ শতাংশে উন্নীত করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সরকারকে মুদ্রানীতির অবস্থান শক্ত রাখার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছর সামষ্টিক অর্থনৈতিক একত্রীকরণের বছর এবং এটি উচ্চ বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির বছর হবে না। কঠোর আর্থিক অবস্থানের মাধ্যমে বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা মুদ্রাস্ফীতির লক্ষ্য অর্জনের মূল চাবিকাঠি হবে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘ডলারের উচ্চ প্রবাহের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করেছে।’ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার পর মূল্যস্ফীতি কমাতে জোরালো পদক্ষেপ দরকার। অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ উপদেষ্টার বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা প্রয়োজন। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা খুবই উদ্বিগ্ন।’ দেশ যে কঠিন পরিস্থিতিতে, অর্থনীতি যে জটিল অবস্থায়, তা পুরোপুরিই বুঝতে পারছেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিতে নানান ধরনের সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকের সমস্যা রয়েছে, মূল্যস্ফীতির সমস্যা রয়েছে। আরো অনেক ধরনের জটিলতা আছে। সব ক্ষেত্রেই কাজ করতে হবে।’
শ্লথ অর্থনীতি একবারেই গতিশীল হয়ে যাবে, তা মনে করছেন না সাবেক এই গভর্নর। তবে ধাক্কাটি দিতে চান তিনি। বলেন, ‘অর্থনীতি একেবারে লাইনচ্যুত হয়ে যায়নি। মন্থর হয়েছে ও গতি হারিয়েছে। আমরা গতি বৃদ্ধি করব। সুবিধা হলো, বাংলাদেশের মানুষের অফুরন্ত কর্মস্পৃহা আছে।’
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ