১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালন করা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন- শুধু আমাদের নয়, রাষ্ট্রীয়ভাবে এই শোক পালন করা উচিত নয়। কোনো দিন সিঙ্গেল কয়েকজন মেজর বা আর্মি অফিসার মিলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই অভ্যুত্থান ঘটাতে পারত না। বরং এটা সামগ্রিক ক্ষোভ ছিল এবং সবার যে নিরবতা, তা সমর্থনেরই লক্ষণ।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
দীর্ঘ আধাঘণ্টার সংবাদ সম্মেলনে গতকাল ১৫ আগস্ট ঘিরে ঘটে যাওয়া নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন সারজিস আলম।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট যখন এ ঘটনাটি ঘটে, পুরো বাংলাদেশে মিষ্টি বিতরণ হয়েছিল। কারণ, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের ঘটনা যদি দেখেন, তখন স্বৈরাচারের চরম মাত্রা ছিল। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাই, যা হয়েছে এক জায়গা থেকে হয়েছে, সাধারণ মানুষের প্রতিফলন ছিল না। সাধারণ মানুষ তার বিচার পায়নি, বরং বিচার নির্দিষ্ট ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২সহ কয়েকটি ঠিকানা থেকে সারাদেশে যেত। ওই সময় সেটি (১৫ আগস্টের ঘটনা) সামগ্রিক বিপ্লবের ফল ছিল আসলে।
সারজিস আলম বলেন, ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানে যেসব আওয়ামী নেতাদের ওপর অত্যাচার হয়েছে ধরে নিলাম, তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, তাদের নামে মামলা হয়েছে। এটার জন্য শোক পালন করব? যদি না করি; ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের জন্যও আমরা শোক পালন করব না।
সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সারজিস বলেন, ১৬ বছর পর জনবিস্ফোরণ ঘটার পর সবাই সবার জায়গা থেকে যতকিছু বলার বলেছে। কিন্তু ১৬ বছর ধরে সবাই কথা বলত, তাহলে এ পর্যায়ে যেত না। ফলে দায় নিতে হলে সবাইকে নিতে হবে। ডিবি হেফাজতে আমাদেরকে ছয়দিন আটকে রাখা হয়েছে; আমরা অসংখ্য সংবাদ সম্মেলন করেছি, প্রচলিত গণমাধ্যমে ঠিকভাবে আসেনি। সে দায়টুকু আপনাদের ওপর বর্তায়। আমরা কর্মসূচি দিয়েছি, বিভিন্ন মানুষ তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে বা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ তাদের অস্থিতিশীল উদ্দেশ্য নিয়ে এতে এসেছে। সংখ্যালঘু বিষয়েও এমন অস্থিতিশীলতা আমরা দেখেছি।
সারজিস আলম বলেছেন, মানুষকে বিবস্ত্র করা থেকে গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনাগুলো যারা ঘটিয়েছে, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। এগুলো কোনোভাবেই আইনসংগত নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যা করা প্রয়োজন, একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই কাজটি করবে। আমাদের যে দুজন ছাত্র-প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারে আছেন, তাদের মাধ্যমে যেভাবে বিচার নিশ্চিত করা যায়, আমরা সেই কাজটি করব।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে মতিঝিল হেফাজতের সমাবেশে অসংখ্য আলেম-ওলামাকে কান ধরে উঠবস করিয়েছে। তেমনি যদি কেউ করে, সেটা আমরা সমর্থন করব না। আমাদের জায়গা থেকে স্পষ্ট বার্তা, ১৫ আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কেউ ফুল দিয়ে তার শোক পালন করতে চায়, আমরা আমাদের জায়গা থেকে তাকে বাধা দিতে পারি না।
সারজিস বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে যাদের অবদান অনস্বীকার্য তাদেরকে স্মরণ করতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের যতটুকু সম্মান প্রাপ্য, তা তাকে দিতে হবে; একইভাবে জিয়াউর রহমানের যে সম্মান প্রাপ্য, তাকে তা দিতে হবে। তার কাজের সমালোচনা আপনি করতে পারেন, তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে করা যাবে না।
সারজিস আলম বলেন- স্বাধীন বাংলাদেশে যখন যে ক্ষমতায় এসেছে, তখন শুধু তার সুপ্রিম মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে, বাকিদের শ্রদ্ধা জানানো দূরের কথা, উল্টো ছোট করা হয়েছে। যার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য, ইতিহাসে যে জায়গাটুকু তারা ধারণ করেন, তা তাদের দেওয়া হয়নি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বার্তা দিয়েছেন সারজিস আলম।
তিনি বলেন, ‘আমাদের স্পষ্ট বার্তা, যেখানে যখন পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টিম আসবে, তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ছাত্রসমাজকে সেখান থেকে সরে যেতে হবে। আপনাদের অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্লাসে ফিরে যেতে হবে।’
সারজিস বলেন, ‘বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়েছিলেন। তার গাড়িতে হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। কেন? তিনি যদি ওই রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন, তিনি সেখানে ফুল নিয়ে যেতে পারেন, আমরা বাধা দিতে পারি না। বরং আমরা যদি মনে করি, তিনি যে রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন, যে ব্যক্তিকে তিনি অনুসরণ করেন, তিনি অনুসরণযোগ্য নন, আমরা তাকে বয়কট করতে পারি।
সারজিস স্পষ্ট করে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ ধরনের কোনো কিছুকে প্রমোটই করে না যে কেউ একজন কোনো একটি হোস্টেলে গিয়ে সার্চ করবে, কোনো একটি আবাসিক হোটেলে যাবে, কোনো একজন অধ্যাপককে জোর করে নামিয়ে দেবে। আমরা এগুলো সমর্থন করি না। আমরা কোনো অথরিটি নই।’
তিনি বলেন- আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে পতনের পর পর বিশাল একটি সুবিধাবাজ গোষ্ঠী, যারা আগে ছিল ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ; তারা নতুন রূপ ধারণ করেছে ভুয়া আন্দোলনকারী, সমন্বয়ক হয়ে উঠেছে। তারা তাদের জায়গা থেকে বিভিন্ন কমিটি তৈরি করছেন। আমরা ৫ আগস্টের পর কোনো কমিটিই দেইনি। এখন অসংখ্য ভুয়া সমন্বয়ক তৈরি হয়েছে। তারা হয়ত ব্যক্তিগত স্বার্থ অথবা রাজনৈতিক সিদ্ধিসাধন বা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই এসব করছে।
সমন্বয়ক সারজিস বলেন, ‘আমরা এমন খবরও পেয়েছি যে, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে নাকি একটি কমিটি হয়েছে, যারা মসজিদে গিয়ে মসজিদ কমিটিকে পদত্যাগ করতে বলেছে। অথচ আমরা আমাদের জায়গা থেকে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কমিটি দিয়েছিলাম। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য এবং কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এই মানুষগুলো এমন কিছু কাজ করছে, যা অপ্রত্যাশিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসার পর আমরা এই প্ল্যাটফর্মটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
নয়াশতাব্দী/টিএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ