বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অনেকে মাঠে কাজ করেছে, রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে, অনেকে সামাজিক মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে মাস্টার স্ট্রোক খেলেছে। তাদের সবার চেষ্টার যোগফল একটি নতুন সরকার, একটি নতুন বাংলাদেশ। নাম জানা এবং নাম না জানা সবার চেষ্টাকে সম্মান করে এ নতুন বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালেও যুদ্ধের ময়দানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ইতিহাস যাদের নামটুকুও জানে না। মুক্তিযুদ্ধ কেউ ভাতা পাওয়ার জন্য বা কোটা পাওয়ার জন্য করেনি। আজ যারা কোটার জন্য এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবীতে এক দফা আন্দোলর করে জীবন দিয়েছে তারা প্রাপ্তির জন্য কিছু করেনি। সবার মাঝে চেতনা ছিল স্বৈরাচারকে উৎখাত করে বৈষম্যবিরোধী দেশ গড়া। সেনাবাহিনীকে নিয়ে বেশি কথা বলা যায় না তবুও কিছু সরল সত্য কথা জনগণের জানার হক আছে। ভালো ব্যাটসম্যানও সব বল ভালো খেলে না। স্বৈরাচার তার কয়েকজন অনুগত দিয়ে হত্যা গুম খুন করে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ চেষ্টা করতে চেয়েছিল। সেনাপ্রধান আত্মীয়তার পরিচয়কে পেছনে ফেলে জনগণের কাতারে দাঁড়িয়েছেন। তার বলিষ্ঠ চেষ্টা দিয়ে শেষ দমন নিপীড়ন পরিকল্পনাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এই ভূমিকা পালন করতে গিয়ে সেনাপ্রধান জীবনহানির চরম আশঙ্কা থেকে বেঁচে গেছেন। মহান আল্লাহ তাকে বাঁচিয়েছেন বাংলাদেশের জন্য। তিনি আত্মীয়তাকে নয় জনগণকে বেছে নিয়েছেন। তিনি একজন নির্মোহ জেনারেল যিনি চিফ মিলিটারি ল অ্যাডমিনিস্ট্রেট হননি, জনগণের চাওয়াকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন। দেশকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধানসহ তার সঙ্গী জেনারেলদের বলিষ্ঠ ভূমিকাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ না করলে অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে চিহ্নিত হবো আমরা।
সেনাবাহিনীর ভিতরের খবর বাইরে আসে কম। প্রতিটি সেনাসদস্য ও অফিসারই এ মাটির সন্তান। বাহিনীর হাতেগোনা কিছু অফিসার অপরাধ কর্মে জড়িয়েছিল, তারা চিহ্নিত। তাদের কর্মই তাদের কর্মফল নির্ধারণ করে দেবে। আমরা মুসলমানরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ ছাড় দেন ছেড়ে দেন না। চোখের সামনে ঘটা সব কিছু মিরাকেলের মতো পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তীতে আবার কেউ স্বৈরাচার হতে চাইলে তার পরিণতিও এমন ধরনের হবে। এক সময় অধৈর্য হয়ে মানুষ যেই সেনাবাহিনীকে গালি দিত আজ সেই সেনাবাহিনী জনগণের চোখের মণি। সব অর্জনের একটা সঠিক সময় আছে। এক সাগর রক্ত দিয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। আজ আবার অনেক রক্তের দাম দিয়ে সফলতা অর্জিত হয়েছে।
আত্মীয়তার সম্পর্ক যদি সব কিছু হতো তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়ে শুরু হওয়া বিরোধে মাসুদ উদ্দীন আহমেদ খালেদা জিয়ার বিপক্ষে যেত না। ১/১১ এর অনেক খারাপ অর্জন ছিল ভালোও কিছু ছিল। ১/১১ এর প্রশংসা করছি না কিন্তু তা বাস্তবে ঘটেছে তাই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
কেউ কেউ সেনাপ্রধানের আত্মীয়তার উদাহরণ দেয় এটা বাস্তবতা। কিন্তু সেনাপ্রধান আত্মীয়তার বেড়াজাল ভেঙে জনগণের কাতারে দাঁড়াতে গিয়ে প্রচণ্ড চাপের শিকার হয়েছিলেন,কিন্তু সাহস হারাননি। এই বিপ্লব উইলস অব দ্য পিপল। খোদ সেনাপ্রধানই বিপ্লবের কি পয়েন্টের নেতৃত্বদাতা। সেনাপ্রধানও মুক্তি পেয়েছেন তার ওপরে হওয়া বৈষম্য থেকে। সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েও তার মাথার ওপরে চেপে ছিল এক সিরিয়াল অপরাধী গুম খুনের দোসর সাবেক জেনারেল তারেক। ৫ তারিখের বিজয়ে সেনাপ্রধানও মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিয়েছেন।
বর্তমান সব জেনারেলই স্বৈরাচার আমলে প্রমোশন পেয়েছেন তাই বলে সবাই ক্যু করে ফেলছে না। জিয়াউর রহমানও সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিল বলা হয়, তাই বলে জিয়াউর রহমান কি কমান্ড ভেঙে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেনি? সঠিক সময় মানুষের বিবেককে সঠিক পথে চালিত করে। আন্দোলনের মাঝপথে রক্তপাত বাড়ছিল। জাতিসংঘের এক্সপার্ট বলেছিলেন অধৈর্য হবেন না, আপনাদের বিজয় সামান্য দূরে। লাস্ট কষ্টটুকু পাড়ি দিতে হবেই।
প্রত্যেকের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। নিজে অতিজ্ঞানী হয়ে গেলে তা অহংকারের জন্ম দেয়। অহংকারীকে মহান আল্লাহ পছন্দ করে না। মূসা নবী নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী বলায় মহান আল্লাহ তাকে মোজেজা দিয়ে বাস্তবতা বুঝিয়ে দিয়েছেন। আমাদের মাঝে মোজেজা আসবে না। মহান আল্লাহর পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ করলে অনেক কিছুর ধারণা পাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে পদে থাকা একজন জেনারেল গেলে আরেক জেনারেল আসবেন। তার প্রমোশনও বিগত সরকারের আমলে হয়েছে। একটা অফিসারকে ওপরে তুলতে রাষ্ট্রের অনেক সময় লাগে। বিডিআর বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার হারিয়েছে। সন্দেহ বাড়ালে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। অফিসারদের মোটিভেট করে সঠিক জায়গায় আনাই এখন সাফল্য। যারা গুম খুনসহ বা বড় অপরাধে জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে কিছু সময় লাগবে। দেশ অনেক অগোছালো হয়ে আছে। গণবিপ্লব মানে ধ্বংসের উন্মাদনা নয়।
বর্তমান সেনাপ্রধান বিচক্ষণতার সঙ্গে এখনো সব ঠিক রেখেছেন এবং করে চলছেন। কাকে কোন দায়িত্বে রাখবে এটা তার নিজের ও তার সঙ্গীদের অনেক চেষ্টা ও চিন্তার বিষয়। সিভিলিয়ান থেকে এনে আর্মি চালানো যাবে না। শিক্ষা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা একদিনে অর্জন হয় না বা ফেসবুকে লিখেও হয় না। যেই সেনাপ্রধান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে তার ওপরে আস্থা রাখা উচিত। তিনি দেশের ক্রান্তিলগ্নে সর্বোচ্চ পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাকে কাজ করার সময় দিতে হবে। সবারই কম বেশি ভুল হয়, সমালোচনাকারীদেরও ভুল হয়। সমালোচনা করা উচিত তবে তা গঠনমূলক এবং তথ্যসমৃদ্ধ সমালোচনা হওয়া জরুরি। সেনাপ্রধানের কমান্ড চ্যানেল অটুট আছে। চরম সময়ে জনগণের আস্থা অর্জন করে দেশ বাঁচানো সেনাপ্রধান ও তার জেনারেলদেরকে দেশ গড়ার কাজে সময় দিতে হবে। এক সপ্তাহ বা এক মাসে ধ্বংসস্তূপ হওয়া এ দেশকে বদলে দেয়ার মতো সুপারম্যান কেউ নয়। সেনাপ্রধান ও তার জেনারেলরাও রক্ত মাংসের মানুষ। তাদের সাফল্যের মধ্য দিয়েই এই গণবিপ্লবের পূর্ণতা আসবে আশা করি।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ