ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দেশ স্বাধীন একবারই হয়

প্রকাশনার সময়: ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৪৭

পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই। কেন কোথায় কী হয়েছিল দেশবাসী তো বটেই পুরো বিশ্বই জেনেছে ইতোমধ্যে। যদি কিছু আড়ালে থাকে, তবে তাও বের হবে একদিন। কারণ দুনিয়াজুড়ে তথ্যভান্ডার এখন উন্মুক্ত। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন এবং তাদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, তারা দ্রুত শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা শুরু করবেন এবং নাগরিক জীবনে যে অনিরাপত্তা এবং অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে তা নিরসনে উদ্যোগ নেবেন। অতীতেও গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনরা পদত্যাগ করেছেন। তবে এবারের বিষয়টি অতীতের কোনো ঘটনার সঙ্গেই মিল নেই।

দেশজুড়ে এখন দুটি বিষয় খুব আলোচিত। এক. প্রতি রাতেই ঢাকা শহরের কোথাও না কোথাও ডাকাত পড়ছে। প্রতিটি এলাকায় স্থানীয়রা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। এক এক এলাকায় ডাকাত প্রবেশের খবর মসজিদে মাইকিং হচ্ছে সেখান থেকে এলাকাবাসী জানছেন। তাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিচ্ছেন, সেখান থেকে জানছেন এফবি বন্ধুরা। এলএমএম সিস্টেমে তা বন্ধু থেকে বন্ধু, তাদের বন্ধু, আবার তাদের থেকে তাদের বন্ধু অবধি ছড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আতঙ্ক আর এক জায়গায় থেমে থাকছে না। শহরজুড়ে ডাকাত আতঙ্কে ভুগছে মানুষ।

আরেকটি বিষয় আলোচনায় রয়েছে তা হলো গুজব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে যে সত্য বলছে আর কে যে গুজব ছড়াচ্ছে তা যাচাই করার সময়ও মিলছে না। এক হাত থেকে আরেক হাতে বেহাত হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসের গতিতে। কিন্তু কেউ এর দায় নিতে চাইছে না। বরং একে অন্যকে দায়ী করে পার পাওয়ার প্রতিযোগিতাই প্রকট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। যারা সাধারণ মানুষ তারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন আবার অনেকে আস্থায় নিতে গিয়ে বিপদেও পড়ছেন। অনেকের মধ্যে জেনে বুঝে গুজব ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতাও লক্ষ করা গেছে। অতীতে গুজব ছড়িয়ে হিন্দুদের মন্দির, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বৌদ্ধদের উপাসনালয় পুড়তে, লুটতেও দেখেছি। এসব ঠেকাতে বিগত সরকার গুজব প্রতিরোধে ফাইবার ফোর্স গঠন করেছিল। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে এখন। কিন্তু সংকট মুহূর্তে দেখা গেল তা কোনো কাজেই আসল না। শুধু যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো হয় তা না, ব্যক্তির বিরুদ্ধেও গুজব ছড়িয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবন ছারখার করে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। কিন্তু এর গতিরোধ করা যায়নি। তবে গতি প্রতিরোধ করা উচিত। কারণ গুজব ছড়ানোর সর্বনাশা খেলায় এ দেশেরই ক্ষতি হয়েছে বারবার।

দেশ উত্তাল ছিল বেনজীর, মতিয়ার, আনার, আবেদ আলীসহ বেশ কিছু শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের নিয়ে। এক একজনের সম্পদের যে বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে যা আলাদীনের চেরাগকেও হার মানিয়ে দেয়ার মতো বিস্ময়কর। বাংলাদেশের ইতিহাসে আনার হত্যার মত ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংসদ সদস্যের এত নৃশংস হত্যাকা্ল হয়েছে কিনা জানা নেই। কোনো ব্যক্তির ওপর কতটা জিঘাংসা বা ক্ষোভ থাকলে ভিন দেশের মাটিতে এরকম নির্মম হত্যার পরিকল্পনা করা যায়, তা অনুমান করাও কঠিন। দুর্নীতিবাজদের আরো কিছু বিষয় সামনে আসতে শুরু করেছিল। পত্রিকার পাতায় আমরা দেখেছি, তাদের অনেকেই আতঙ্কে ছিল কে কখন ধরা পড়ে এই ভয়ে। বিদায়ী সরকার এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগেই রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে আর এগোবে কিনা সময় তা বলবে।

শুরুতে ছাত্র আন্দোলনের বিষয় ছিল, কোটা সংস্কার। ২০১৮ সালে সরকারের উচ্চপদে নিয়োগে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন হলে সব ধরনের কোটা বন্ধ করে দেয় সরকার এবং এ বিষয়ে তখন পরিপত্র ঘোষণা করা হয়। বিষয়টি এক অর্থে নিষ্পত্তিই হয়ে গেছিল। পরে এ পরিপত্রের বিরুদ্ধে আপিল হয়। এর শুনানি চলছিল। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরকালে ৫ জুন ২০২৪ পরিপত্রটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় আদালত। ছাত্ররা আবার রাস্তায় নামে। তারা কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের দাবি তোলে। আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ থেকেও আপিল করা হয়। সরকার এবং ছাত্রদের আপত্তিতে আদালত ৫ জুনের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করে, অর্থাৎ ২০১৮ সালের পরিপত্রই বহাল। ছাত্রদের দাবির সঙ্গে সরকার একমত, সরকার ছাত্রদেরই পক্ষে। একে একে মেনে নেয়া হয়েছিল সব দাবি। তবুও কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘটনা প্রবাহে কীভাবে সরকার উৎখাত আন্দোলনের দিকে মোড় নেয় তা কারো অজানা নয়। তবে অনেকেই বলেছেন, ছাত্রদের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা ছাত্রদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চাইছে। আজ আর সেই প্রসঙ্গে না-ই গেলাম। চোখের পলকে যে প্রেক্ষাপট বদলে গেছে তা আর এখন কারো অজানা নেই।

এ আন্দোলনে ছাত্র-জনতার জয় হয়েছে। ছাত্রদের কেউ কেউ সমন্বয়ক কোটায় অন্তবর্তী সরকারেও স্থান পেয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলণকে যারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা এবং এ স্বাধীনতায় প্রথম শহীদ, দ্বিতীয় শহীদ শব্দ ব্যবহার করছেন তারা ঠিক করছেন না এমন মত রয়েছে অনেকের। তারা বলছেন, একটা দেশ একবারই স্বাধীন হয়। সেটাও অন্য দেশের কবল থেকে নিজ দেশকে যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করা হলে। আর এ যুদ্ধে যারা শত্রু দেশের সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে রক্ষা করেন তারাই মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্ররা শুরু করেছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরে সেটি রাজনৈতিক আদল পেয়ে সরকার পতনের এক দফায় পরিণত হয়। তারা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে তো যুদ্ধ করেনি। কোনো সরকারকে জনগণের পছন্দ না হতেই পারে। তাকে উৎখাত করার জন্য আন্দোলন হতেই পারে। বিগত সরকারের বিরুদ্ধেও এটি ছিল গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হয়েছে। এই আন্দোলনের সফলতাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলার কোনো যুক্তি নেই।

মনে রাখা দরকার, গণঅভ্যুত্থান বারবার হয়। অতীতেও হয়েছে, আগামীতেও হয়তো আরো হবে। তবে দেশ স্বাধীন একবারই হয়। মুক্তিযোদ্ধা, বীরপ্রতিক, বীরশ্রেষ্ঠ, শহীদ, গাজী তারাই হন যারা দেশ এবং ধর্ম রক্ষায় যুদ্ধে অংশ নিয়ে নিহত হন বা যুদ্ধ করেও বেঁচে যান। তবে এর মানে এই নয় যে, যারা কোটা আন্দোলনে নিহত হয়েছেন তাদের অবদান ছোট করে দেখা হচ্ছে। তাদের মর্যাদা তাদের মতো করেই দিতে হবে। বরং অন্য কোনো অর্জনের সঙ্গে এদের অবদান গুলিয়ে ফেললেই তাদের ছোট করা হবে। এ যুগের তরুণদের সামনে পুরো জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত। তারা ইচ্ছে করলে খুব সহজেই এ ব্যাপারে বিশদ জানতে পারবে।

পনেরো বছরের একটানা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থেকেও যদি কোনো সরকার জনমানুষের মৌলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে জনবিস্ফোরণ ঘটা খুব স্বাভাবিক। মেনে নিতে নিতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখনই সাধারণ মানুষ সব বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগোতে থাকে। এগিয়ে যাওয়াটা, মুখোমুখি হওয়াটা তখন তাদের কাছে অস্তিত্ব রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর তাদের কোনোকিছু দিয়েই আটকে রাখা যায় না। কোটা আন্দোলনকে ঘিরে জনবিস্ফোরণ এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

কিন্তু সব জাতির একটি ভিত থাকে। সেই ভিতটা কখনো নাড়িয়ে দিতে হয় না। শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ ছিল, তাকে মসনদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু জাতির জনক, সাত বীরশ্রেষ্ঠ, ভাষা শহীদ, শিল্পাচার্য, শিক্ষানুরাগী এদের প্রতিকৃতির ওপর আঘাত হানা, ভেঙে চুরমার করে মাটিতে মিশিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা নিজের উপরই আঘাত হানা। এতে তাদের অসম্মান হয়েছে। এ মানুষগুলো তারাই যারা আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছে। এই মানুষগুলো তারাই যারা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে স্ব স্ব কাজের মাধ্যমে সমুন্নত রেখেছে। তাদের মাটিতে মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তা আমাদের জন্য লজ্জার। আমরা নিজেরাই নিজেদের নীচতাকে প্রতিষ্ঠা করেছি। হয়তো এখন এর ক্ষতিটুকু অনুমান করা যাচ্ছে না, তবে ইতিহাস একদিন তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। সেদিনও আমরা জাতি হিসেবে লজ্জা পাব নিজেদের কাছেই।

জাতি হিসেবে আরো একটি লজ্জার চিত্র তুলে ধরে আজকের লেখা শেষ করি। শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়েছেন, পদত্যাগ করেছেন তিনি। দেশ ত্যাগ করেছেন। এরপর বুভুক্ষের মতো গণভবনে হামলে পড়েছেন। যে যেভাবে পেরেছেন সব লুট করে নিয়ে এসেছেন। যুক্তি দেখাচ্ছেন এগুলো জনগণের টাকায় কেনা। তাই অধিকার আছে এগুলো কেড়ে নেয়ার। সব ঠিক আছে। কিন্তু একজন নারী হিসেবে তাকে ন্যূনতম সম্মানটুকু তো দেখানো যেত। তার অনেক ভুল, অন্যায়, গোঁয়ারতুমি, স্বেচ্ছাচারিতা ছিল। অস্বীকার করা যাবে না। পাশাপাশি এ দেশ ও জাতির জন্য তিনি কম কিছুও করেননি। সেটুকু মনে না রাখলে একদিন আজকের এ অর্জনও ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যেতে পারে।

তরুণদের একাংশ দাদির বয়সি একজন নারীর একান্ত পোষাকগুলো নিয়ে যে উলঙ্গ নৃত্য করেছে, তা বারবার একাত্তরের ধর্ষকদের চেহারাই মনে করিয়ে দিয়েছে। তিপ্পান্ন বছরেও যে এই জাতি মানুষ হতে পারেনি, পরিবার থেকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা পায়নি তা পুরো বিশ্ব দেখল। এ লজ্জা রাখি কোথায়?

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ