ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর বড় ধাক্কা লেগেছে ব্যাংকিং খাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে পালাবদলের হাওয়া লেগেছে। বিক্ষোভের মুখে পড়ে অনেকে পদত্যাগও করেছেন। এছাড়া একটি বেসরকারি ব্যাংকে এসব নিয়ে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। পুরো ব্যাংক খাতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা। ভেঙে পড়েছে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ব্যাংকে সার্বিক লেনদেন ব্যাহত হয়েছে। এটিএম বুথে দেখা দিয়েছে নগদ অর্থের সংকট। ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন গ্রাহক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। তবে আগের মতো পুলিশ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। আবার এই সময়ে অনেকেই ব্যাংক থেকে নগদ টাকা বেশি উত্তোলন করে ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীল করতে পারে। সে জন্য নিরাপত্তার স্বার্থেই ব্যাংক নগদ টাকার সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুশাসনের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতি থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা চলে যায় গুটিকয়েক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে এখন সেই ব্যাংকগুলো দখলমুক্ত করতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ব্যাংকগুলো থেকে বিতাড়িত মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে ব্যাংক খাতে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ তদারকি যারা করবে, সেই বাংলাদেশ ব্যাংকেও চলছে অস্থিরতা। তবে ব্যাংক খাতের এ পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকের ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ বন্ধ রয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এদিকে ব্যাংকে ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সারা দেশে নিরাপত্তার অভাবে বেশির ভাগ ব্যাংকের এটিএম বুথ বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর সব শাখা এখনো খোলেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকের টাকা তুলতে পারছেন না। আর এতেই নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়েছেন মানুষ।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ এটিএমে অর্থ সরবরাহের কাজটি করা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তৃতীয় পক্ষের এ সেবা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে বেশির ভাগ এটিএমে টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বন্ধ হয়ে গেছে দেশজুড়ে বেশির ভাগ ব্যাংকের এটিএম সেবা।
এদিকে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে আগে থেকেই নড়বড়ে আর্থিক খাতে। বিগত বছরগুলোতে হাতছাড়া হওয়া ব্যাংকগুলোর দখল নিতে মরিয়া আগের উদ্যোক্তারা। বর্তমান পরিচালকদের অপসারণে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ব্যাংকে সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা বিক্ষোভ করছেন। বিভিন্ন গ্রুপ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি-কর্তাদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেয়া ও দুর্নীতিবাজ অনেক কর্মকর্তাকেও ব্যাংক থেকে বের করে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। আটকে দেয়া হচ্ছে স্বার্থসংশ্লিষ্টদের শত শত কোটি টাকার চেক। আবার ব্যাংকের দখল ধরে রাখতে বিক্ষুব্ধদের ওপর গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ব্যাংক গ্রাহকরা। গ্রাহকরা জানান, ব্যাংক খাতে এখন যে অস্থিরতা চলছে, তাতে আমরা দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আরিফুল ইসলাম নামের ইসলামী ব্যাংকের এক গ্রাহক নয়া শতাব্দীকে বলেন, ব্যাংকে যেভাবে সংঘর্ষ হচ্ছে তাতে আমাদের মধ্যে নানা শঙ্কা কাজ করছে। কখন কী হয়? বোঝা যাচ্ছে না। যখন টাকা উত্তোলনের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। যাতে করে শঙ্কা আরও বাড়ে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের আমানত নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমানত রাখার পর যে সময় যা দরকার— তা যদি উত্তোলন করতে না পারি তাহলে তো নানা শঙ্কা দেখা দিবেই। আগের সরকার যেভাবে ব্যাংকে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা তছরুপ করেছে— তাতে শঙ্কা আরও বাড়ছে।
অন্যদিকে নগদ টাকার অভাবে এক বড় ধরনের সংকটে পড়েছেন ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। কারণ ব্যাংক থেকে দৈনিক নগদ টাকা তোলার সীমা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকে নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক গ্রাহক তার প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা পাননি। কারণ নিরাপত্তার অভাবে নিয়মিত নগদ টাকা এটিএম বুথ ও ব্যাংকের শাখায় পাঠানো যাচ্ছে না।
কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, যদি নগদ টাকার সংকট বাড়তে থাকে এবং আগামী সপ্তাহেও বিধিনিষেধ চলতে থাকে তবে তারা আরও কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বেন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে তাদের ব্যবসা বন্ধ।
ঢাকার অন্যতম বড় কাঁচাবাজার কারওয়ানবাজারের তেলের পাইকারি বিক্রেতা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্ট সেখান থেকে এক লাখ টাকার বেশি তোলা যাচ্ছে না। বিষয়টা খুবই সমস্যার। ব্যবসা চালাতে সমস্যায় পড়ছি। বেশির ভাগ ব্যবসায়িক লেনদেন এখন ব্যাংক থেকে ব্যাংকে পাঠানো হচ্ছে। আরেক বড় পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোববার আমার কারখানায় যে পরিমাণ টাকা পাঠানোর কথা ছিল, তা পাঠাতে পারিনি। আমার ১০ লাখ টাকা দরকার। পেয়েছি মাত্র দুই লাখ টাকা। তিনি আরও বলেন, যারা দিনভিত্তিক কাজ করেন তাদের পুরো টাকা দিতে পারছি না। আমি শ্রমিকদের এই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে বলেছি। কারণ এখন নগদ টাকা তোলার উপায় নেই। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে কিছু বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন যে তারা সমস্যায় পড়েছেন। বেতন দেয়ায় সমস্যা করা উচিত না। খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার মতো হঠাৎ খরচ বা অন্যান্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতেও সমস্যা হচ্ছে।
পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনলাইন লেনদেন করাই ভালো। অনলাইন লেনদেনের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে যে এটি নিরাপদ। এটি একটি ভালো দিক যে নিরাপত্তার স্বার্থে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সীমা আরোপ করেছে। তিনি বলেন, যিনি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পান তার ব্যাংক বা বিকাশ অ্যাকাউন্ট নেই তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ধরনের কথা কেউ বললে তা অযৌক্তিক মনে হবে।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ