ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এ দিন ক্ষুব্ধ জনতা গণভবন-সংসদ ভবনসহ পুলিশ স্থাপনায় আক্রমণ করে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থানাগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। জীবন রক্ষায় আত্মগোপনে চলে যায় পুলিশ। এরপর জনমনে সৃষ্টি হয় ভীতি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করে ৮ আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর ক্রমেই আতঙ্ক কেটে জনজীবনে ফিরতে শুরু করেছে স্বস্তি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথ গ্রহণের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গত রোববার ছিল তাদের প্রথম কর্মদিবস। প্রায় সবাই নিজ নিজ দপ্তরে উপস্থিত থেকে দিয়েছেন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট নানাবিধ নির্দেশনা আর সাবধান করেছেন দুর্নীতিবাজদের। চুপসে গেছে চোর-ডাকাত-দুর্নীতিবাজরা। এরই মধ্যে উচ্চ আদালত, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ প্রতিটি সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কাজে ফিরছে পুলিশ বাহিনী। প্রায় এক সপ্তাহ কর্মবিরতির পর গতকাল সোমবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দায়িত্ব পালন শুরু করেছে ট্রাফিক পুলিশ। ভয়-শঙ্কা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটিয়ে মানুষ হয়ে পড়ছেন কর্মব্যস্ত। ঢাকাসহ দেশব্যাপী খুলেছে অফিস-আদালত, দোকানপাট ও বিপণিবিতান। শুরু হয়েছে যানবাহন চলাচল। সব মিলিয়ে আবার ফিরে আসছে স্বাভাবিক অবস্থা। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় হয়ে উঠছে কর্মমুখর। গ্রাহকের ভিড় জমছে ব্যাংকপাড়ায়। অফিস-আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ উপস্থিতির মাধ্যমে পুরোপুরি শুরু হয়েছে কার্যক্রম। ঢাকার দোকানপাট, মার্কেট, শপিংমল ও বিপণিবিতান খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রাণ ফিরে পাচ্ছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। চাকা ঘুরছে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর। ঢাকার বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন জেলার দূরপাল্লার গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে। মোকামগুলো থেকে পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকার বিভিন্ন পাইকারি বাজারে আসছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলছে বন্দরগুলোয়। স্বাভাবিক হয়েছে বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও। গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানি এবং সিটি করপোরেশনের সেবামূলক কার্যক্রম একই গতিতে চলছে। একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এতে স্বস্তি ফিরে আসছে সাধারণ মানুষের জীবনে। তারপর কিছুটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়ে গেছে জনমনে।
এদিকে এ ভীতিকর অবস্থা ও নৈরাজ্য বন্ধ করে শান্তি ফেরাতে গত ১৯ জুলাই মধ্য রাত থেকে সারা দেশে জারি করা হয় কারফিউ। পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য ঢাকাসহ সারা দেশে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এরই মধ্যে তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন আর রশীদ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে নিরাপত্তার অজুহাতে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রাখে এবং একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করায়, যাতে বলা হয়, তারা সব আন্দোলন প্রত্যাহার করছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বুঝে ফেলে এ বক্তব্য জিম্মি করে আদায় করা। তাই তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আ’লীগ সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগ এবং সব হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ ৯ দফা দাবি প্রস্তাব করেন শিক্ষার্থীরা। সরকার চাপে পড়ে আশ্বাস দেয়, সব হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে এবং আটক ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয়। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে ৩১ জুলাই সরকারিভাবে শোক ঘোষণা করা হয়। সারা দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ সেই শোক প্রত্যাখ্যান করে এবং কালোর বদলে লাল রং ধারণ করেন। ৩১ জুলাই সম্পূর্ণ ফেসবুক ছেয়ে যায় লাল রঙের প্রোফাইল পিকচারে। এর পর আসে সরকার পদত্যাগের একদফা এবং ঢাকা মার্চ কর্মসূচি। শেষ রক্ষায় ৪ আগস্ট আবারো কঠোর অবস্থানে যায় সরকার। এদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু সব ভয় উপেক্ষা করে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা রাজধানীর চারদিক থেকে গণভবন অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় ভাঙচুর-লুটপাট। অবস্থার অবসানে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। কিছু জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। যেমন সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, গণভবন ও ধানমন্ডি ৩২ নম্বর। এগুলো তো শেখ হাসিনার কিছু না। এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। বহু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সেখানে ছিল। এগুলো তচনছ হয়ে গেছে। ফলে যা গেছে তা তো গেছেই। এখন আর কিছু যেন নষ্ট না হয় সেদিকে নতুন সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। এরপর তারা নানা ধরনের উদ্যোগ নেবেন সেটা ঠিক আছে। প্রথমেই মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফেরাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠন করে কাজে নামাতে হবে। তাদের কাজে না নামানো পর্যন্ত মানুষের মধ্যে কিন্তু স্বস্তি আসবে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নতুন যে সরকারটি গঠন হয়েছে, সে সরকারের প্রথম কাজ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা। মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি যে কাজগুলো করতে হবে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যে একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন, সেটা কমাতে হবে। আবার পার্লামেন্টে কোনো এমপি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। এটা তো বাকস্বাধীনতা হলো না। দলের কোনো সিদ্ধান্তে কোনো এমপি একমত নাও হতে পারেন, ফলে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। এমন অনেক কিছুই করতে হবে। এসব কাজের কিছু কিছু এ অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো পারবে না, পরবর্তী সংসদে এগুলো করতে হবে।’
এদিকে, মতিঝিল ও সচিবালয়ে অফিস করতে যাওয়া অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর মতিঝিল ব্যাংকপাড়া ও সচিবালয় এলাকায় জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক। টানা ৩ সপ্তাহ পর স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে রাজধানীর বাজারে। পাইকারি পর্যায়ে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি দাম কমেছে খুচরা বাজারেও। দেশের এমন পরিস্থিতির মধ্যেও দাম কমতির দিকে থাকায় স্বস্তি জানিয়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। এছাড়া বন্ধ থাকা বেশির ভাগ দোকান এদিন খুলেছে। বাজারে বেড়েছে ক্রেতার উপস্থিতিও।
নয়াশতাব্দী/জিএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ