ঢাকা, সোমবার, ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২৯ পৌষ ১৪৩১, ১২ রজব ১৪৪৬

সড়ক নিয়ন্ত্রণে চরম বিশৃঙ্খলা

প্রকাশনার সময়: ১০ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৫৩

আরাফ মাহিন। বয়স মাত্র সাত বছর। দক্ষিণের জেলা বাগেরহাট পুলিশ লাইন্স স্কুলের প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরাফ। ফুচকা খাওয়ার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা নিয়ে একটি বাঁশি কিনে পুলিশ লাইন্স স্কুলের সামনের সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করে। শিশু আরাফের দায়িত্ব পালনের তেমনই একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে যোগাযোগ মাধ্যমে। অথচ শিশু আরাফ মাহিন ট্রাফিক আইন কিংবা নিয়ম-কানুন তেমন কিছুই জানেন না। শুধু শিশু আরাফই নয় এমন অপরিপক্বদের কার্যক্রমে সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে বেশি। কোটা সংস্কার আন্দোলন দমন করতে পুলিশের নির্বিচারে গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনায় পুলিশ ও ছাত্র সমাজের মধ্যে চরম আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। একের পর এক সহিংসতায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। আন্দোলনের এক পর্যায়ে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা-ফাঁড়িসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটে। আগুনের ঘটনায় পুলিশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। কর্মস্থল ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় পুলিশ সদস্যরা। এমন অবস্থায় দেশজুড়ে সড়কে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি নেই। সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। থানাগুলোতে পুলিশী কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কিন্তু সড়ক-মহাসড়কের ভেঙে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সচল হয়নি। এসব সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও যানজট নিরসনে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা, সড়ক ব্যবস্থাপনা ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করা সংগঠন। তবে এদের অনেকেই জানেন না ট্রাফিক আইন কিংবা নিয়ম-কানুন। যার ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থায় ঘটছে অনেক ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ও বিপত্তি।

এ ব্যাপারে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি বলেন, আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার জন্য গাড়িতে করে পপুলার ধানমন্ডি শাখায় যাওয়ার সময় সড়কে ভোগান্তির পাশাপাশি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ঢাকা কলেজের সামনে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ১০/১২ জন তরুণ গাড়ি থামাল এবং গাড়ির কাগজপত্র দেখল। কয়েক গজ এগুতে আরেক গ্রুপ ফের গাড়ি থামাল এবং আবারো কাগজপত্র দেখে একখানা পাস ইস্যু করল। সিটি কলেজের সামনে আবার থামাল। এবার পাস দেখিয়ে রক্ষা। গাড়িতে আমার অসুস্থ মেয়ে ব্যথায় কাঁদছে আর আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পথেও একই ঘটনা। বাসায় মেয়েকে রেখে মসজিদে এলাম এবং পথে একই বাধা...। এ সময় রাস্তা পার হওয়া পাবলিকের বিরক্তি, রিকশাওয়ালা, ড্রাইভারসহ আম জনতার কথা শুনলাম। যে ভাষায় তারা গালি দিচ্ছিল তা উচ্চারণ অযোগ্য।

ফেজবুক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘মনের দুঃখের কথা কাকে বলব! ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নাকি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে? কি হচ্ছে ঢাকার রাজপথে! এভাবে চললে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নতুন সরকারের জন্য কতটা বিব্রতকর হবে তা আজ (গতকাল) নিজের চোখে না দেখলে আন্দাজ করতে পারতাম না।’

এদিকে শিক্ষার্থীরা বলেন, যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে নিজেদের দায়িত্ববোধ মানবিকতা থেকেই আমরা এ কাজ করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি ট্রাফিক সিস্টেম সক্রিয় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ কাজ করে যাব। তবে সবাইকে সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, শহরকে যানজটমুক্ত করতে হলে সবাইকে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হবে। ফুটপাত দখল করা যাবে না। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আগামী দিনের সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে আমরা কাজ করে যাব বলে জানায় তারা।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যেসব শিক্ষার্থী দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অনেকেই স্কুলের গন্ডি পার হয়নি। তাদের বেশির ভাগেরই ধারণা নেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে। অনেকে আসছেন সখের বসে। রাজধানীর ইসিবি মোড়ে দ্বায়িত্ব পালনকারী নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রুকাইয়া জানান, ফেসবুকে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের ছবি দেখে সে এসেছে। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। রুকাইয়ার মতো অনেক শিক্ষার্থীকেই বাঁশি-লাঠি হাতে সড়কে দেখা যায়। এদিকে কিশোর-কিশোরীদের সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনে অনেক অভিভাবক দুশ্চিন্তার কথা জানান। রাজধানীর পল্লবীতে কথা হয় সোনিয়া হক নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তিনি বলেন, সন্তানের আবদারে তাদের ছাড়তে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সময়টা ভালো না কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। তা ছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আরো ভয় হয়। তিনি বলেন, বেশির ভাগ মেয়েই তাদের বন্ধুদের ডাকে সড়কে নেমেছে। এ বয়সে তারা যে কোনো ফাঁদে পা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি দরকার। কারণ ট্রাফিক সিস্টেমটা সাধারণত সেন্ট্রালি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কোন সড়কে কখন ট্রাফিক বেশি কোন সড়কে কম এটা শিক্ষার্থীদের জানার কথা না। তাছাড়া এরই মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এখন সড়কে যান বাহন কিছুটা কম থাকলেও আশা করা যায় কাল রোববার থেকে সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচল শুরু হবে। তখন কোনো অবস্থাতেই শিক্ষার্থীদের দিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বিশৃঙ্খলা আরো বাড়বে। রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ে দায়িত্ব পালনকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি সকালে বাসায় ফেরার সময় দেখলাম এখানে কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। এতে চতুর্দিকে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তাৎক্ষণিক কয়েকজন মিলে চার রাস্তায় দায়িত্ব নিয়েছি। ট্রাফিক পুলিশ যে দায়িত্বটুকু পালন করে আমরা সেটুকু পালনের চেষ্টা করছি। কিন্তু সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক করার চেষ্টা করলেও কিছুটা ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।

সাইদুল ইসলাম নামে অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, গাড়ির শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা সাধ্যমতো এখানে দায়িত্ব পালন করছি। যতক্ষণ না ট্রাফিক পুলিশ এখানে আসবে ততক্ষণ আমরা দায়িত্ব পালন করব। তবে অবশ্যই তাদের মতো হবে না। কিছুটা সমস্যা তো থাকবেই।

ইতঃপূর্বে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনটির বেশির ভাগ ধারার প্রয়োগ এখনো শুরু হয়নি। বলতে গেলে আইন প্রয়োগের শিথিলতা, সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা, চালক-মালিকদের বেপরোয়া মনোভাব পুরো সড়ক ব্যবস্থাকে দিন দিন অনিরাপদ করে তুলছে বৈকি। এর সুষ্ঠু বিহিত এখন সময়ের দাবি। সত্য যে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে সুপারিশ দিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। দেশে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এসব সুপারিশ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নের সময় এসেছে। শুধু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নয়, সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভেবে দেখা উচিত। নিরাপদ সড়ক তৈরির জন্য সুপরিকল্পিত নকশা এবং এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে কাজ করাটা জরুরি।

মহাসড়কগুলোয় ফিডার রোড দিয়ে কম গতির গাড়ি, মোটরবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা দরকার, যাতে দুর্ঘটনা হ্রাস পায়। আর মহাসড়কের পাশে থাকা বাজার, মানুষজন রাস্তা পারাপার হয়— এমন স্থানগুলোয় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি তরুণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি সেচ্ছাসেবী ট্রাফিক বাহিনী গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান ট্রাফিক ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী সমন্বয়কদের দাবিতে সড়কে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোয় আজকাল আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। এমনকি ভারতও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সনাতনী কায়দায় চলছে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। বাইরের অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নিয়ে দুর্ঘটনা কমাতে প্রযুক্তিভিত্তিক নানা উদ্ভাবনী সমাধানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে সড়ক-মহাসড়কে বাড়াতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি। অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিনিয়োগ এখনো অনুল্লেখযোগ্য। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক এক্ষেত্রে নৈপুণ্য বাড়াতে বিনিয়োগের ওপর জোরারোপ করেছে। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) অর্থায়ন নিশ্চিত করা যেতে পারে। সর্বোপরি বাড়াতে হবে জনগণের সচেতনতা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পিত উদ্যোগে দেশে টেকসই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে প্রত্যাশা।

নয়াশতাব্দী/জিএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ